বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায়। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য ঢাকার তেজগাঁওয়ে মিশনারিজ অব চ্যারিটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন মাত্র ৪ বছর বয়সে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই হাসপাতালেই মৃত্যু হয় মায়ের। এরপর বড় হয়েছেন রাজশাহী উপ-শহরের এসওএস চিলড্রেন্স ভিলেজে (অনাথ আশ্রম)। রাজশাহীতে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্ত্রী আর ২ সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছে তার দিনকাল। কিন্তু এতকিছুর পরও মানসিক প্রশান্তি নেই তার। আজ অবধি জন্মদাতা বাবা-মায়ের পরিচয় জানতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন। গত ১৯ বছরে দুই বার বাংলাদেশে এসে ঢাকার তেজগাঁও মিশন এবং রাজশাহীর অনাথ আশ্রমে গিয়ে আপন বাবা-মার পরিচয় খোঁজ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু যেখানেই গিয়েছেন নিরাশ হয়ে ফিরেছেন। তবে শিশু বয়সে ঢাকার মিশন, রাজশাহীর অনাথ আশ্রম আর বরিশালের কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তিনি।
হতভাগা এই ব্যক্তির নাম মনোয়ার মুকুল (৪৬)। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্ত্রী আর ২ ছেলে নিয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। সেখানে আইটি সেক্টরে চাকরি করেন তিনি।
রাজশাহী উপ-শহরের এসওএস চিলড্রেন্স ভিলেজের কেস হিস্টোরি অনুযায়ী, মনোয়ারের জন্ম ৩১ জুলাই ১৯৭৬ সালে। ১৯৮০ সালের ২৫ জুলাই এসওএস চিলড্রেন্স ভিলেজে এডমিশন (ভর্তি) করা হয় তাকে। ৪ বছর বয়সের শিশু মনোয়ারকে সাথে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তেঁজগাওয়ে মিশনারিজ অব চ্যারিটি হাসপাতালে যান তার মা। শিশুটির বাবা মারা গেছেন বলে মিশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল তার মা (অজ্ঞাতনামা)। চ্যারিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মা মারা যায়। কিন্তু তার কোনো ঠিকানা বা কন্ট্রাক্ট পয়েন্ট (যোগাযোগের স্থান) ছিলো না তাদের কাছে। চ্যারিটি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, শিশুটির যাওয়ার (আশ্রয়) বা দেখভাল করার কেউ ছিলো না। শিশুটি তার মায়ের কথা ছাড়া আর কিছুই বলতে পারেনি তাদের।
আশ্রমে প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ করার পর ওই আশ্রমের ইয়্যুথ ফ্যাসিলিটিজ বিভাগে থেকে রাজশাহীর গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, সরকারি রাজশাহী কলেজ এবং সব শেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন মনোয়ার। ২০০০ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। মাস্টার্স অধ্যয়নরত অবস্থায় রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান রুয়েট) প্রভাষক হিসেবে কিছুদিন অধ্যাপনা করেছেন তিনি। প্রায় ৬ মাস প্রভাষকের চাকরি শেষে ঢাকার তৎকালীন ডেসকোতে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে যোগ দেন মনোয়ার। ডেসকোতে ৮ মাস চাকরি শেষে ২০০৩ সালে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তিনি।
পড়াশোনা-বিদেশ গমনসহ দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে বাবার নাম প্রয়োজন হলে শিশু পল্লীর লালনকারী সেই মায়ের স্বামীর নাম নিজের বাবার নাম হিসেবে ব্যবহার করেন মনোয়ার।
সিডনি থেকে মুঠোফোনে মনোয়ার বলেন, রাজশাহী অনাথ আশ্রমে তার নাম মনোয়ার মুকুল রাখেন তাকে লালনকারী মা। পারিবারিক নাম ছিলো বদিরুল কিংবা বদি। আশ্রমে বুদ্ধি বলে ডাকা হতো তাকে। মনোয়ার ইসলামী নাম হলেও তার বাবা-মা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলো তা অস্পষ্ট।
মনোয়ারের ভাষায় তাদের বাসার কাছে একটি বড় রাইস মিল ছিল। মিলে তার মা শ্রমিকের কাজ করতেন। মিলের সামনে ধান শুকানোর খোলা জায়গা এবং মিলের গা ঘেঁষে ছিলো ফসলের ক্ষেত। বাসার কাছে একটা বড় হাসপাতাল ছিল। হাসপাতালের কাছেই ছিলো একটি ওভারহেড পানির ট্যাংক। ট্যাংকের কাছে পুকুরে মাছ ধরতেন স্থানীয়রা। বাড়ির পাশে পূজা হতো।
বরিশাল নগরীর বেলতলা এলাকার আকিব ফ্লাওয়ার মিলের স্বত্ত্বাধিকারী মো. শাহজাহান জানান, ১৯৮০ সালে বরিশালের একমাত্র রাইসমিল ছিলো আমানতগঞ্জ মহাবাজ। অটোরাইস মিলের মালিক ছিলেন মোহাম্মদ সিকদার।
মোহাম্মদ সিকদারের ছেলে বাদল সিকদার বলেন, তার এ ধরনের কিছু মনে পড়ছে না। ওই সময় যারা মিলটি চালাতেন তাদের কেউ বেঁচে নেই। তবে মিলটি ধান ক্ষেতের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিলো। মিলের পেছনে একটি খাল রয়েছে। বর্তমানে মিলের জায়গায় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা/শফিক