বগুড়ার বাজারে পাটের মন তিন হাজার টাকা করে বিক্রি হলেও খুশি হতে পারছে না চাষিরা। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এবং কৃষি শ্রমিকের মূল্য বেশি হওয়ায় পাট উৎপাদনে খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে চাষিরা বাজারে পাট বিক্রি করে স্বস্তি পাচ্ছে না। জেলার বিভিন্ন হাটে হাটে নতুন পাট উঠলেও বিক্রির টাকায় গায়ে গায় শোধ হচ্ছে বলেই দাবি কৃষকদের।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বগুড়া জেলায় চলতি বছর পাট চাষ হয় ১২ হাজার ২৫৭ হেক্টর জমিতে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় সর্বশেষ ১০ হাজার ৯৬৫ জমিতে চাষ হয় এবং একই পরিমাণ জমির পাট কর্তন করা হয়। কৃষকরা বিভিন্ন উপায় করে পাট কেটে জাগ দিয়ে নতুন আঁশ বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন। প্রতি হেক্টরে ১৩.৮৪ বেল ফলন ধরা হয়েছে সেই হিসেবে জেলায় প্রায় দেড় লাখ বেল পাট উৎপাদন হয়েছে এবার। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় পাটের ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু পাট উৎপাদনের পর জাগ দেওয়ার সময় ভালো বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাট চাষিদের নানা ধকল পোহাতে হয়েছে। বেশিরভাগ চাষি দূরের নদী, খালে, পুকুরের পানিতে পাট জাগ দিয়ে আঁশ ছাড়িয়ে নিয়েছে। যে কারণে চাষিদের পাট চাষে শেষ পর্যন্ত খরচ বেড়ে যায়। চলতি বাজারে এবার পাটের মণ বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকায়।
বগুড়ার শেরপুরে হাট-বাজারে উঠতে শুরু করেছে সোনালি আঁশ পাট। ভালো দামেই বিক্রি হচ্ছে পাট। এছাড়া পাটের ফলনও হয়েছে বাম্পার। এরপরও কৃষকের মুখে হাসি নেই। কারণ পাট কাটা, জাগ দেওয়া ও আঁশ ছড়ানোর কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভবান হচ্ছে না এই উপজেলার কৃষকরা।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, চলতি মৌসুমে এই উপজেলায় দুই হাজার দুইশ’ পঞ্চাশ হেক্টর জমিতে পাটের চাষ করা হয়। শুরু থেকেই আবহাওয়া মোটামুটি অনুকূলে থাকায় পাটের ফলনও হয়েছে ভালো। তবে পাট কাটার পর জাগ দেওয়ার সময় সমস্যায় পড়েন। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দূর-দূরান্তে নিয়ে পাট জাগ দিয়ে আঁশ ছড়ানো হয়েছে বলে সূত্রটি জানায়।
শেরপুর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের শুবলী গ্রামের কৃষক জামাল উদ্দিন জানান, তিনি এবার দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করেন। কিন্তু পাট কাটা ও জাগ দেওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বাড়তি টাকা দিতে হয়েছে। প্রতি বিঘা জমির পাট কাটতে ছয়জন শ্রমিক প্রয়োজন। এজন্য ছয়শ’ টাকা হারে মজুরি হিসেবে দিতে হয় তিন হাজার ছয়শ’ টাকা। আর পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাট জাগ দেওয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় পড়েন। তাই জমি থেকে অনেক দূরে ডোবায় নিয়ে গিয়ে পাট জাগ দিতে হয়। এজন্য প্রতি বিঘায় আরও বাড়তি শ্রমিক ব্যয় হয় চার হাজার টাকা। এছাড়া পাটের আঁশ ছড়াতেও একই পরিমাণ টাকা শ্রমিক বাবদ খরচ হয়। অর্থাৎ শুধু পাট কাটা থেকে শুরু করে আঁশ ছাড়ানো পর্যন্ত প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছে দশ হাজার আটশ’ টাকা। এছাড়া জমি তৈরী, সার-বীজ, নিড়ানিসহ পাট শুকানো বাবদ খরচ হয়েছে আরও ছয় হাজার টাকা। সেই হিসেবে পাট চাষে প্রতি বিঘায় খচর প্রায় সতের হাজার টাকা। কৃষক জামাল উদ্দিনের দাবি, ওই জমি থেকে ছয় মণ পাঠ উৎপাদন হয়েছে। বর্তমান বাজার দর অনুযায়ী সেই পাট বিক্রি করে পেয়েছেন আঠারো হাজার টাকা। খরচ বাদে মাত্র এক হাজার টাকা অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু জমির ভাড়া ধরলে কোনো লাভই টিকবে না। লাভ শুধু পাট খড়ি।
সোলায়মান আলী নামের আরেক কৃষক বলেন, এবার পাটের ফলন হয়েছে। প্রতি বিঘায় ছয় থেকে সাত মণ হারে পাটের ফলন হয়েছে। পানি সংকটের কারণে জমি থেকে পাট কেটে অন্যত্র নিয়ে গিয়ে পাট জাগ দিতে হয়েছে। আবার শ্রমিক মজুরিও বিগত বছরের চেয়ে এবার অনেক বেশি। তাই উৎপাদন খরচ বেশি হয়েছে। ফলে ভালো ফলন ও দামে পাট বিক্রি করেও খরচ উঠছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে স্থানীয় হাট-বাজারে গিয়ে দেখা যায়, পাট বেচা-কেনা বেশ জমে উঠেছে। পাটের আমদানিও বাড়তে শুরু করেছে। ভ্যানে করে নতুন পাট নিয়ে আসছেন কৃষকরা। ক্রেতা-বিক্রেতারা দর কষাকষি করেই পাট বিক্রি করছেন। ফলে ভালো দামও পাচ্ছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাটে প্রতি মণ ভালো মানের পাট বিক্রি হচ্ছে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত। এরপরও কৃষক লাভবান হতে পারছেন না।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান জানান, চলতি বছর বগুড়ায় পাটের উৎপাদন ভালো হয়েছে। মাঝে কয়েকদিন বন্যার কারণে কিছু পাট নষ্ট হয়েছে। বন্যায় পাট নষ্ট না হলে জেলায় পাটের উৎপাদন আরো বাড়তো। প্রতি হেক্টরে ১৩.৮৪ বেল ফলন ধরা হয়েছে। বগুড়ায় এবার বাজারে পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন চাষিরা।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল