দেশের সেরা লিচু হয় দিনাজপুরে। আর এই দিনাজপুরের রসালো ও স্বাদে ভরা লিচু হয় মাসিমপুর গ্রামে। সুস্বাদু রঙিন চোখ জুড়ানো রসালো লোভনীয় বেদনা লিচুর গ্রাম মাসিমপুর। দিনাজপুরের লিচুর ঐতিহ্য নিয়ে এই গ্রাম থেকেই বিপ্লব সাধন করেছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির চারপাশ, উঠান এমনকি বসতবাড়িই যেন লিচু গাছের তলায়। দেশের বিভিন্ন স্থানে লিচু বিক্রির দৃশ্যপটে মাসিমপুরের লিচু বলেই বিক্রি হতে দেখা যায়।
অথচ অপরিকল্পিত শিল্পায়নের বজ্র শোধনাগার না থাকায় দিন দিন এই এলাকার ফল উৎপাদন কমে যাচ্ছে, পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। মানুষের চেখেরও সমস্যার সৃষ্টি করছে এই অটো রাইসমিলগুলোর চিমনি থেকে নির্গত ছাই। অটো রাইসমিলগুলোর চিমনি থেকে নির্গত ছাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। কতিপয় চালকল শ্রমিক খরচ বাঁচাতে ছাই পরিস্কারের পরিবর্তে চিমনি দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসে এমন দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসী।
অন্যদিকে চালকল মালিকগণ বলছেন, বিসিক শিল্প এলাকায় কোন বজ্র শোধনাগার না থাকায় অটো রাইস মিলগুলোর বজ্র ব্যবস্থাপনা করে পরিবেশ সুরক্ষিত রাখা কঠিন।
এখন লিচু বাগানগুলোতে মকুলের ম-ম গন্ধ। কিছুদিনের মধ্যেই আসতে শুরু করবে গুটি। গুটি থেকে লিচু পরিপক্ক হতে ২০/২৫ দিন সময় লাগে। লিচুর রঙ আসতে শুরু করলেই বাগানিরা বাগানে বসাবে বাঁশের মাচার পাহারা। গাছে গাছে টাঙানো হবে ‘ধড়কো’ নামক স্থানীয় যন্ত্র। যা দিয়ে বাদুড়সহ কাক তাড়ানো হয়। রাতে বাদুড় থেকে রেহাই পেতে চলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। গাছে ঝুলানো হয় বৈদ্যুতিক লাইটও। এতসব ব্যস্ততা প্রতিবছর মার্চে লিচু ফুলের মুকুল আসা থেকে ফল পাকা ও পাড়ার সময় মে-জুন পর্যন্ত চলতে থাকে।
তবে যুগ যুগ ধরে চলে আসা সংস্কৃতি বদলেছে। কমছে উৎপাদন, কেটে ফেলা হচ্ছে বাগান। ওই এলাকার আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠেছে অটো রাইস মিল। মিলগুলো থেকে নির্গত বজ্র পানি আর ছাই, ধুলোবালুতে মাসিমপুরের লিচুর ঐতিহ্য আজ ম্লান হতে বসেছে। শত বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি নষ্টে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের শিকার। মাসিমপুর, আউলিয়াপুর, খামারঝাড়বাড়ি, উলিপুর, মহব্বতপুর মিলে কয়েক গ্রামে লিচুর শত বছরের বাগানগুলোতে ফুল আসছে সময়মতই কিন্তু আসেনা ফল।
সংশ্লিষ্ট এলাকার উদ্ভিদ, পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠক ও উত্তরবঙ্গ মৌচাষী সমিতির সদস্য মোসাদ্দেক হোসেন জানান, চালকলগুলো থেকে নির্গত ধুলো ও ছাইয়ের কারণে পরাগায়ন ঘটে না। লিচুর পুষ্পরস ধুলো বালুতে ঢেকে যায়। ফলে মৌমাছিও বসেনা ফুলে।এতে লিচু বাগানগুলোতে দিন দিন কমছে ফলন। অনেকে কেটে ফেলছেন লিচু বাগান। প্রতিকার চেয়ে উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার আবেদন করেও মিলেনি প্রতিকার।
এলাকাবাসীরা জানান, এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করলে অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ফলে শত বছরের লিচুর ঐতিহ্য রক্ষা করা যাবেনা। দিনাজপুরের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মাসিমপুরের লিচুকে রক্ষায় পরিবেশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়নের দাবিও জানান তারা।
ওই এলাকার আসাদুজ্জামান লিটনসহ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, অটো রাইসমিলগুলোর চিমনি থেকে নির্গত ছাই শুধু প্রকৃতির ক্ষতি করছে তা নয়। এলাকায় যে কোন মানুষের চোখে এই ছাই পড়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। প্রতিটি বাড়ীতে বা গাছ-গাছালিতে দেখলেই বোঝা যাবে এই ছাইয়ের উপস্থিতি।
বিসিক দিনাজপুরের উপ মহাব্যবস্থাপক প্রকৌঃ মোঃ গোলাম রব্বানী জানান, আমাদের পক্ষ থেকে জেলার সমন্বয় কমিটির সভায় বিষয়টি জানানো হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও জানানো হয়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর দিনাজপুরের সহকারী পরিচালক একেএম ছামিউল আলম কুরশি জানান, অটো রাইসমিলগুলোর নির্গত ছাই সহনীয় পর্যায়ে আনতে পরিবেশ অধিদপ্তর কাজ করছে। শিঘ্রই সবাইকে নিয়ে উদ্ধুদ্ধরন সভা করা হবে। আশা করছি চলতি বছরের মধ্যে শতভাগ এই ছাই উড়ানোর বিষয়টি সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে। সমস্যা কেটে যাবে।
বিডি প্রতিদিন/এএ