আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি, কথাশিল্পী, ছড়াকার ও ঔপন্যাসিক।
জন্ম ১৯৩৪ সালের ২০ এপ্রিল কুমিল্লা জেলার মনোহরগঞ্জ উপজেলার ল্যসর গ্রামে। বাবা আবদুল আউয়াল ও মা হাফসা খাতুনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় পিতৃহারা হন। জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বড় হন তিনি এবং ভাইবোনকেও তৈরি করেন মানুষ হিসেবে।
ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখির প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল মুসলেহউদ্দিনের। স্কুল-কলেজজীবনে দেয়াল পত্রিকায় লেখা এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পত্রিকায় লেখার মাধ্যমে তার লেখালেখির সূচনা।
আশির দশকে দুহাতে লিখেছেন তিনি। কি গল্প, উপন্যাস কিংবা ছড়া আর কিশোরদের জন্য। সর্বত্র ছিল তার অবাধ বিচরণ। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয় লেখক। একটানা লিখেছেন ওদের জন্য। বিশেষ করে শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল আকাশচুম্বী।
তার হাস্যরসে ভরা ছিল টইটম্বুর ছড়া। গাছগাছালি ও পাখপাখালি নিয়ে মজার মজার কবিতা আর রোমাঞ্চে ঠাসা রহস্য আর গোয়েন্দা কাহিনী যা পাঠক মহলে আজও সমাদৃত। আরও লিখেছেন হালকা মজাদার অসংখ্য হাসির গল্প। গা ছমছম করা বিভিন্ন অভিযানের কাহিনী। লিখেছেন মিষ্টি মজাদার ছড়া। তার ছড়ার মূল উপজীব্য ছিল গ্রামবাংলার রূপ আর সমসাময়িক সব ছোটখাটো ঘটনার জীবন্ত বর্ণনা। ছোটগল্প লেখায় মুসলেহউদ্দিন ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ওর ছোটগল্প পড়া শুরু করলে পাঠক একটানা না পড়ে উঠতেই পারত না। ছোট গল্পগুলোর মধ্যে ছিল মোপাসীয় চমক। ‘পুরুষ’ তার অন্যতম ছোট গল্প। এ দেশের শ্রমজীবী মানুষ এবং তাদের ওপর নানাবিধ নির্যাতন ও নিপীড়নের সত্য কথন বর্ণনাই ছিল তার সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য বিষয়।
আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা প্রায় শতাধিক। এর মধ্যে কাব্যগ্রন্থ তিনটি। উপন্যাস ২০টি, শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ ২০টি, শিশু-কিশোর গল্প-উপন্যাস প্রায় ৩০টি এবং ঐতিহ্য ও জীবনীভিত্তিক গ্রন্থ ৫টি। তিনি তার সাহিত্যকর্মের জন্য আসাফউদ্দৌলা রেজা স্মৃতিসাহিত্য পুরস্কার, কবি আবুল হাসান স্মৃতিসাহিত্য পুরস্কার, কবি জসীমউদ্দীন স্মৃতিসাহিত্য পুরস্কার, ফরিদপুর পৌরসভা সাহিত্য পুরস্কার ও সুহূদ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। জনপ্রিয় এই কথাশিল্পী কখনই পুরস্কার পাওয়ার জন্য সাহিত্যচর্চা করেননি বরং তিনি লিখেছেন আমাদের বাংলা সাহিত্যকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য।
আশির দশকে তার লেখা গল্প-উপন্যাসের পাঠকপ্রিয়তা তাকে অনেক বেশি জনপ্রিয় করেছিল। তার লেখার মূল উপজীব্য ছিল গ্রাম বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখ গাঁথা জীবনের বাস্তব গল্প, শহুরে জীবনের বাস্তবতা ও তার আশপাশের চরিত্র।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন কিছুদিন শিক্ষকতা শেষে পরবর্তীতে তত্কালীন সিএসপি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। জীবদ্দশায় বাংলাদেশ সরকারের পুলিশ বিভাগেব ভারপ্রাপ্ত আইজির দায়িত্ব পালন করেন এবং বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। চাকরি জীবনের শেষ ভাগে বিটিএমসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন। ব্যক্তিজীবনে তিন কন্যার জনক। আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন মাত্র ৬৮ বছর বয়সে ঢাকার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে ইন্তেকাল করেন। তাকে তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা ও এতিমখানা প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। এই কথাশিল্পীর অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।