সে অনেক আগের কথা। এক দেশে এক রাজা ছিল। সে যেমন ছিল বিশাল সম্পদের মালিক, তেমনই শরীরেও অনেক বড়। সেই রাজা সবসময়ে মৃত্যুর কথা চিন্তা করত এবং ভাবত কী করে অমর হওয়া যায়। তো এক দিন রাজা রাজসভায় ঘোষণা করে দিল যে, তার তিন দিনের মধ্যে অমৃত হওয়ার উপায় চাই। তিন দিনের মধ্যে কেউ এনে দিতে না পারলে সবার গর্দান নেওয়ারও হুকুম দিলেন তিনি। রাজার কথা শুনে সবাই তো ভয়ে অস্থির। ঘোষণা শোনামাত্রই সব মন্ত্রী, সভাসদরা দলবেঁধে অমর হওয়ার উপায় খুঁজতে বের হলো। খুঁজতে খুঁজতে দুই দিন পার হয়ে গেল। তৃতীয় দিন তারা এক গভীর জঙ্গলের মধ্যে পেয়ে গেল এক ইয়া বড় দাড়িওয়ালা সাধুকে। তাকে পাওয়া মাত্রই সবাই যেয়ে তাকে ধরল-
- ‘বাবা, আমাদের বাঁচান। রাজামশাই বলেছেন-তাকে অমর হওয়ার উপায় না বলে দিলে সবার গর্দান নেবেন। একটা উপায় বাতলে দিন।’
-সাধুবাবা মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন-
‘শুন হে বৎসরা। অমর হওয়া খুব সহজ নহে। সেই সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে পাবে একটা বৃক্ষ। সেই বৃক্ষেই মিলবে অমর হওয়ার ফল।’
-সাধুবাবা, সাত সমুদ্র তেরো নদী ছাড়া কাছাকাছি কোনো জায়গা নেই?
-তা আছে। একটু রূপকথার গল্প থেকে ধার করলাম। তবে শুন এখান থেকে সামনে আগালেই পাবে এক নদী। নদী পার হয়ে সামনে পড়বে এক রাস্তা। সে রাস্তায় তোমরা যাবে না। তারপর এগোলে পাবে আরেকটি রাস্তা। সেখানে যাইবে না আর তাহার পরে যে রাস্তা পড়িবে, সেটাতেও না।
-বাবা, তাহলে কোন রাস্তায় যাব?
-আহা, কথার মাঝখানে বাধা দাও কেন। এভাবে চলতে চলতে সপ্তম যে রাস্তা পড়বে সেখানে সোজা যাবে। একটু আগালেই পাবে এক পুরোনো মন্দির। মন্দিরের ভিতরে পাবে এক শিলপাঁটা। সেই শিলপাঁটার গায়েই লেখা রহিয়াছে, অমর হওয়ার ওষুধের বিবরণ। সে সবকিছু একত্র করে ওই শিলপাঁটায় পিষলে পাবে অমর ওষুধ।
-বাবা, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এবার আসি।
-আসো, তবে যাওয়ার সময়ে ভরা হাতে যেতে হবে কেন, হাত কিছুটা খালি করলে ভালো হয়।
-জি বাবা, তা আর বলতে... হেহ হেহ হে..।
সে যাই হোক। তো রাজার লোকেরা সাধুবাবার কথামতো সেই মন্দিরে গেল এবং শিলপাঁটাও পেল। শিলপাঁটার গায়ে লেখা একটি ছড়া-
কাঁকড়া ও তেলাপোকার ডিম কাটছাঁট
সাথে দিতে হবে, ভীমরুলের চাক।
তার সাথে হবে টিকটিকির লেজ,
ভুলবে না দিতে কাঁচালঙ্কার তেজ।
সঙ্গে থাকিবে দুটো পাকা বেল,
ফাটাইয়া সাথে দিবে সরিষার তেল।
তেলের সাথে হইবে গোবরের ছাঁট,
তেল কুচকুচে পাতার সাথে মিটমাট।
এই উদ্ভট ছড়ার নিচে লেখা রয়েছে-
‘উপরের সকল উপকরণ দিয়ে যিনি অমরত্ব লাভ করতে চান তিনি এমন এক পাহাড়ের চূড়ায় উঠিবেন যার একদিকে সমুদ্র এবং অন্যদিকে ভূমি। তাহার পর সমুদ্রের দিকে মুখ করিয়া, সকল উপকরণ একসাথে শিলপাঁটায় পিষিয়া খাইতে হইবে। খাইলেই অমরত্ব লাভ হবে। তবে হ্যাঁ, অবশ্যই অন্য অন্য কোনো শিলপাঁটা ব্যবহার করা যাবে না।’
লেখা অনুযায়ী সবাই উপকরণ সংগ্রহ করতে ছুট লাগাল। আর পাশাপাশি সেই মন্দিরের দেয়ালে একটি সতর্কবাণীও লেখা ছিল-
‘অমৃতসুধা পান করার আগে অবশ্যই মুখে রুমাল পেঁচাইয়া নাক বন্ধ করে রাখতে হবে।’
কিন্তু উপকরণ জোগাড় করতে সবাই এতই ব্যস্ত যে, সতর্কবাণীর দিকে চোখও দিল না কেউ।
সবকিছু জোগাড় করে রাজাকে দেওয়া হলো এবং অমৃতসুধা পান করার নিয়ম বলে দেওয়া হলো। তো লেখা অনুযায়ী একটি পাহাড় খুঁজে রাজামশাই তার চূড়ায় উঠতে শুরু করলেন। কিন্তু বিশাল শরীর নিয়ে তার অবস্থা তো কাহিল। তবুও অনেক কষ্টে তিনি পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেন এবং সমুদ্রের দিকে মুখ করে সব উপকরণ একসঙ্গে নিয়ে পিষতে শুরু করলেন। পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে রাজ্যের সব লোক হইহুল্লোড় করতে করতে রাজার অমরত্ব হওয়া দেখতে লাগল। কিন্তু সব উপকরণ পেষার পর শুরু হলো আসল ঝামেলা, সেই মিশ্রণ থেকে বেরোতে লাগল বিকট দুর্গন্ধ। সতর্কবার্তা না জানায় রাজার নাক ছিল খোলা, আর সেই খোলা নাকেই সেই গন্ধ ঢুকল ভুরভুর করে। আর এতে রাজার পেটের সঙ্গে সঙ্গে মাথাও গেল গুলিয়ে। তিনি গুলানো মাথা নিয়ে বনবন করে ঘুরতে শুরু করলেন এবং একপর্যায়ে পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচের দিকে পড়তে লাগলেন। সবাই হইহই করে উঠল বাঁচানোর জন্য (রাজাকে নয় শিলপাঁটাকে), কিন্তু তার আগেই রাজামশাই চলে গেছেন সমুদ্রতলে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন অমৃতসুধা ও অমর হওয়ার শিলপাঁটাও। রাজ্যের সবাই মিলে খোঁজাখুঁজি করেও রাজাকে পেলই না, সঙ্গে পেল না অদ্ভূত সেই শিলপাঁটাও। তোমরাও চাইলে সমুদ্রে খুঁজে দেখতে পার, বলা তো যায় না, সেই শিলপাঁটা তোমরা পেয়েও যেতে পারো।