২৬ জানুয়ারি, ২০২৩ ০০:২২

অর্থনীতির হুমকি বিলাসী পণ্য আমদানি

মিথ্যা ঘোষণায় অর্থ পাচার, ডলার সংকটে নিত্যপণ্যের এলসি খুলতে হিমশিম

রুহুল আমিন রাসেল ও শাহেদ আলী ইরশাদ

অর্থনীতির হুমকি বিলাসী পণ্য আমদানি

বিলাসী পণ্য আমদানি অব্যাহত থাকায় হুমকির মুখে দেশের অর্থনীতি। সূত্র বলছে, ট্যারিফ কমিশন আগেই সতর্ক বার্তা দিয়ে বলেছিল- অপ্রয়োজনীয় ৩৩০টি বিলাসী পণ্যে শুল্ক বাড়িয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করা হোক। অন্তত ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় হওয়ার মতো এই সুপারিশ আমলে নেয়নি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড- এনবিআর। ফলে ফ্রি স্টাইলে আমদানি হচ্ছে বিলাসী পণ্য। এতে ডলার সংকট যেমন বাড়ছে, তেমনি আমদানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণায় অর্থ পাচারও বাড়ছে। অথচ নিত্যপণ্যের ঋণপত্র বা এলসি খুলতেও ব্যাংকগুলোতে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। অংশীজনরা বলছেন- যে সব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয়, তা আমদানি নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ- ডলার সংকটে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে পারছেন না তারা। কমে আসছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ডলার সংকটের সুরাহা না হওয়ায় জ্বালানিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার জটিলতা দূর হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্যে ফেরেনি স্বাভাবিক গতি। বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার প্রভাবে জ্বালানি, খাদ্য, শিল্পের কাঁচামালসহ সব পণ্যের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার একের পর এক সংকটে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। ফলে, শিল্পকারখানায় মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সংকট দেখা দিয়েছে। আবার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পকারখানায় উৎপাদন অনেকাংশে কমে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। এতে ব্যবসায়ীদের ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। ডলার সংকটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে আসন্ন রমজানে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য আমদানিতে রিজার্ভ থেকে ডলার দেওয়ার সুপারিশ করে ২২ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে ভোজ্য তেল, ছোলা, মসুর ডাল, পিঁয়াজ, চিনি এবং খেজুর আমদানির জন্য ডলারের বিশেষ সংস্থান করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের অনুরোধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়েছিল, জানুয়ারি মাস থেকে ডলার সংকট থাকবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। এটি অব্যাহত থাকলে রমজানে পণ্য সরবরাহে ঘাটতি হতে পারে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমেছে। ৮ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ১১২ কোটি ডলার পরিশোধের পর ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমেছে রিজার্ভ। এখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ দিলে রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ বিলিয়ন ডলারে। আর কিছুদিনের মধ্যে রিজার্ভ সংরক্ষণে নতুন হিসাব অনুসরণ করার ইঙ্গিত দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

দেশের সার্বিক আর্থিক পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করতে সংশ্লিষ্ট দফতর ও মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে ৬ নভেম্বর গণভবনে বৈঠকে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই বৈঠক সূত্র জানায়, ডলারের মজুদ ধরে রাখতে বিলাসী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহী করতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দামি গাড়ি ও ফল আমদানির বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। ৩৩০টি পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা কার্যকরের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি নির্দেশনার আলোকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর ডলার সংকট বিবেচনায় নিয়ে আমদানি খরচ কমাতে শুল্ক-কর কাঠামো পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে কাজ করছে বলে জানা গেছে। এর আগে ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ৩৩০টি পণ্যের তালিকা তৈরি করে। মূলত ওই তালিকা নিয়ে এনবিআর কাজ করছে।

ট্যারিফ কমিশন ৩৩০টি পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর সুপারিশ করে বলেছে, বিলাসী ও কম গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ওপর সাময়িক উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করা হলে দেশীয় শিল্পের ওপর প্রভাব পড়ার আশঙ্কা কম। তাই যানবাহন, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী, গৃহস্থালি সরঞ্জাম, মূল্যবান ধাতু, প্রসাধন, পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সিরামিক পণ্য, সাজসজ্জা সামগ্রী, ফল ও ফুল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও পানীয়, টিনজাত খাদ্য, চকলেট, বিস্কুট, ফলের রস, কোমল পানীয়, অ্যালকোহলজাতীয় পানীয়, তামাক, তামাকজাত বা এর বিকল্প পণ্য ইত্যাদিতে আমদানি শুল্ক (সিডি), সম্পূরক শুল্ক (এসডি), নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) বাড়ানো এবং ট্যারিফ বা শুল্কায়নযোগ্য মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। এই সুপারিশ মানা হলে অন্তত ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সাশ্রয় হতে পারে বলে মনে করছে ট্যারিফ কমিশন সূত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে- ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৪৯ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ২৪ কোটি ডলার। সেই হিসাবে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আগের বছরের তুলনায় ২৮ কোটি ৭ লাখ ডলার বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। অন্যদিকে, কম প্রয়োজনীয় ও বিলাস পণ্য নিরুৎসাহিত করার পরও সার্বিক আমদানি ব্যয় বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্য ও লেনদেনে বড় রকমের ঘাটতি রয়েই গেছে। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বৈদেশিক বাণিজ্য (ব্যালেন্স অব ট্রেড) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার। একই সময়ে বৈদেশিক লেনদেনে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় এই ঘাটতির পরিমাণ ৪৩৬ কোটি ডলার বেশি। লেনদেনের ঘাটতির প্রভাবে ৩২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর