শনিবার, ৮ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সাংবাদিক জীবনের স্মৃতি

আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

সাংবাদিক জীবনের স্মৃতি

১৯৩৪ সালে বরিশালের উলানিয়া গ্রামে আমার জন্ম। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত ওখানে পড়েছি। প্রথমে জুনিয়র মাদ্রাসায়, তারপর উলানিয়া করোনেশন হাইস্কুলে। ১৯৪৬ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর বরিশালে চলে আসি। গ্রামে মাত্র ১২-১৩ বছর কেটেছে। উলানিয়া যদিও গ্রাম; কিন্তু শহরের মতো ছিল। গ্রামে মানুষ হলে মানুষের জাগতিক জ্ঞান কম থাকে। সেই যুগে গ্রামে টেলিফোন-রেডিও, আধুনিক প্রযুক্তির কিছুই ছিল না, কিন্তু আমরা বিশ্বসংবাদ জানতাম, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের খবর শুনতাম।  কলকাতা থেকে আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজাদ, মোহাম্মদী ইত্যাদি বহু কাগজ যেত। ফলে বড় খবরগুলো লোকজন জানত।  শৈশব বড় ভালো কেটেছে। হিন্দু-মুসলিম কালচার আগে অনেকটাই অভিন্ন ছিল। আমাদের সময় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি ছিল। ছেচল্লিশে রায়ট হলেও আমাদের গ্রামে রায়ট হয়নি।

আমার বাবা ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী কংগ্রেসের জেলা কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন, খেলাফতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তখন রাজনৈতিক সহাবস্থান ছিল। একই স্কুলের মাঠে আজকে হিন্দু মহাসভা মিটিং করছে, তো পরের দিন মুসলিম লীগ, তার পরদিন কংগ্রেসের সভা হতো। এখন তো মারামারি হয়, তখন হতো না। কারও বিপক্ষে বিক্ষোভ দেখাতে হলে কালো পতাকা নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে বিক্ষোভ করত, পতাকা প্রদর্শন করা হতো। এসব দেখতে দেখতেই রাজনীতির সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। গ্রামে থাকতেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। প্রথমে ছাত্র কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। ছাত্রলীগ তখনো করিনি। বরিশালে আসার পর আস্তে আস্তে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হলাম এবং ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করলাম, পরে যেটি ছাত্র ইউনিয়ন হয়। এই পার্টিতে কাজ করার সময় ‘আগস্ট মুভমেন্ট’ নিয়ে মতবিরোধ হয় যে স্বাধীনতার আন্দোলনে সমর্থন করা উচিত, কী উচিত না। কমিউনিস্টরা আগস্ট মুভমেন্টে সমর্থন দেয়নি। তখন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে দূরে সরে গিয়ে রেভল্যুশনারি সোশালিস্ট পার্টিতে (আরএসপি) যোগদান করে ওদের ছাত্র শাখা ছাত্র কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হলাম। মধ্যবিত্ত-বিপ্লবী মুসলমানরা তখন কমিউনিস্ট পার্টিতে খুব একটা ছিল না, আরএসপির সঙ্গে ছিল। বিখ্যাত সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, বিখ্যাত সাংবাদিক মোজাম্মেল হক, আবদুল খালেক খানসহ অনেকেই আরএসপির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পাকিস্তান হওয়ার পর ছাত্র কংগ্রেসের নাম ‘ছাত্র অ্যাসোসিয়েশন’ হলো, বরিশাল জেলার সভাপতি ছিলাম। তারপর তো ঢাকায় আসি। দেশভাগের পর আর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, কিন্তু সরাসরি রাজনীতি আর করিনি।

আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ঢাকা কলেজের স্মৃতি। একসঙ্গে এত ভালো সহপাঠী আর তো পাইনি। দাউদ খান মজলিশ, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবু হেনা মোস্তফা কামাল সহপাঠী ছিলেন। কেউ ওপরে, কেউ নিচের ক্লাসে পড়তাম। আমার সঙ্গে অনেক কবি-সাহিত্যিক পড়েছেন, পরবর্তীকালে যাঁরা খুবই নাম করেছেন। মুনীর চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মুতী, শরফুদ্দিনসহ অনেকের সাহচর্যে এসেছি। আরএসপি অফিস ছিল সদরঘাটে, সেখানে যেতাম। বন্ধু মূসা, এবিএম মূসাও আরএসপি করত, কুমিল্লা থেকে আরএসপি সম্মেলনে এসেছিল। সেখানেই তার সঙ্গে ১৯৫০ সালে পরিচয়। আমরা একই সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতেও ছিলাম— বদরুদ্দীন উমর, মোস্তফা কামাল পরে প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন, কুষ্টিয়ার বিখ্যাত গায়ক আনোয়ার উদ্দীন খান; মহিলাদের মধ্যে কামরুন্নাহার লাইলী, নাদেরা বেগম; আমরা সব একসঙ্গে ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিলাম। ভাষা আন্দোলনে আমরা ছিলাম, ১৯৫৫ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলাম।

এখানে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটির কথা বলতেই হয়। ১৯৫২ সালে আমি ঢাকা কলেজের ছাত্র ছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারিতে কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ভাষা সংগ্রাম পরিষদে এসেছি। ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কী হবে না... ভাঙার পক্ষে ভোট হলো এবং মিছিল বের হলো। সে মিছিলে গুলি হয়। আমরা পেছনের দিকে ছিলাম। সে মিছিলেই রফিক শহীদ হন। তাঁর লাশটি ছিল মেডিকেল কলেজের ফ্লোরে। সে লাশ দেখেই সে গানটি, গান তো না, কবিতাটি লিখি— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি।’ কবিতাটি পরে গান হয়ে যায়।

আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন মোটামুটি গতানুগতিক হলেও অন্যদিক থেকে উজ্জ্বল। কারণ বিভাগীয় প্রধান হিসেবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে পেয়েছি, মুনীর চৌধুরী, কাজী দীন মুহম্মদ, অজিতকুমার গুহ, ড. নীলিমা ইব্রাহীমসহ অনেককে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই ১৯৫৫ সালে ছাত্রলীগ অসাম্প্রদায়িক হয়। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলাম। আমরা ‘পূর্ব পাকিস্তান শিল্প সাহিত্য সংসদ’ তৈরি করি এবং সওগাত অফিসকে কেন্দ্র করে সাহিত্যিক আড্ডা জমে ওঠে। আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, সাইয়িদ আতিকুল্লাহসহ অসংখ্য সাহিত্যিক সেখানে আড্ডা জমাতেন। প্রতিদিন সওগাতে আড্ডা দিতাম। মাসে একটি সাহিত্য সভাও হতো, আমরা সব জড়ো হতাম। মাসিক সওগাত ছিল আমাদের মুখপত্র, প্রগতিশীল সাহিত্যের বড় আড্ডাখানা। আজাদ, মোহাম্মদীকে কেন্দ্র করে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে ছিলেন ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান। আমাদের মধ্যে হাতাহাতির নয়, লেখার যুদ্ধ হতো। আমার লেখক জীবনের উন্মেষ এভাবেই। যদিও ঢাকায় আসার অনেক আগে ১৯৪৮ সালে প্রথম গল্পটি লিখি। আমাদের মধ্যে আবুল কালাম শামসুদ্দীন ছিলেন, তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘শাহের বানু’ বের হয়, সব গল্পই জীবন নিয়ে। তখন তো এখানে মধ্যবিত্ত জীবন তৈরি হয়নি। তাঁর অনুকরণে গ্রাম জীবন নিয়ে গল্প লেখা শুরু করি। প্রথম গল্পটি ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় ছাপা হয়। তখন নাইনে পড়ি। পরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগদানের ফলে আমার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হয়, ঢাকায় চলে আসি। কবি আসাদ চৌধুরীর বাবা আরিফ চৌধুরী আমার আত্মীয়। কলতাবাজারে তাঁর বাসায় থাকতাম। বাংলাবাজার থেকে তখন অত্যন্ত উন্নতমানের একটি পত্রিকা বের হতো, ‘সোনার বাংলা’। এ অফিসটি পরে বিউটি বোর্ডিং হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথও সে কাগজে লিখতেন, শামসুর রাহমানের প্রথম কবিতা তাতে ছাপা হয়। সে কাগজে গল্প লেখা শুরু। আহসান হাবীব তখন মাসিক মোহাম্মদীর সম্পাদক। তিনিও গল্প চাইতেন। প্রতি মাসেই দু-একটি করে লিখতে লিখতে গল্প লেখার হাত এসে গেল। তারপর সওগাত বেরোল, তাতে নিয়মিত লিখতাম। ফলে তাড়াতাড়িই অনেক গল্প লেখা হয়ে গেল। প্রথম বই বেরোল ‘কৃষ্ণপক্ষ’। যত দূর মনে হয় ১৯৫৮ সালে এটি প্রকাশিত হয়, বের করেছিল ইস্ট বেঙ্গল পাবলিশার্স। সে বছরই দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘সম্রাটের ছবি’ বের হয়, প্রকাশক সিকান্দার আবু জাফরের সমকাল প্রকাশনী।

আমি যে সাংবাদিক হব, তা কখনো আমার কল্পনায়ও ছিল না। সাহিত্য করে তো অল্প দিনের ভিতরে সাফল্য পেয়েছিলাম। বাংলা একাডেমি, ইউনেস্কোসহ অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি। এরপর দেখা গেল গল্প-কবিতা লিখে পেট চলে না। একেকটি গল্পের জন্য ২৫-৩০ টাকা দেয়, তাও আদায় করতে অনেক ঘুরতে হতো। ফলে সাংবাদিকতা শুরু করি। ‘ইনসাফ’ নামের একটি দৈনিক ছিল, বংশাল থেকে বের হতো। ১৯৫১ সালে সেখানে ৭৫ টাকা বেতনের সাব-এডিটর হলাম। তার আগে বরিশালে ‘নকীব’ আর ‘বরিশাল হিতৈষী’ নামের দুটি কাগজে মাঝেমধ্যে লিখতাম। সিরিয়াস সাংবাদিকতার শুরু কিন্তু ইনসাফে। প্রগতিশীল সাংবাদিক হিসেবে যাঁরা আজকে প্রতিষ্ঠিত, এ কাগজেই তাঁদের যাত্রা— কলকাতায় সাংবাদিকতা শুরু করলেও কে জি মুস্তাফা এ কাগজে ছিলেন; দাউদ খান মজলিশ, সিরাজুর রহমান, এহতেশাম আজাদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী, আমার ভাই বাহাউদ্দীন চৌধুরী সবাই এতে ছিলেন। পরে কাগজটি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৫১ সালের মে মাসে বোধ হয় ‘সংবাদ’ বের হয়। প্রথমে এটি মুসলিম লীগের কাগজ ছিল। আমরা জয়েন করার পরপরই নুরুল আমিন সাহেব কাগজটি কিনে নেন। সংবাদ তখন মুসলিম লীগের কাগজ হয়ে যায়। বহু দিন কাজ করেছি। মাঝে আইএ পরীক্ষা দেব বলে কিছু দিন সাংবাদিকতা করিনি। পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিঞার মিল্লাতে জয়েন করি। কলাম লেখা শুরু মিল্লাতেই। কলাম লিখতে লিখতে ইত্তেফাকে আসি। মার্শাল ল’র আমলে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে আজাদে যোগদান করলাম। আজাদে শুরু ‘তৃতীয় মত’, এখনো চলছে। এই আমার কলামিস্ট জীবন। কলামিস্ট হিসেবে টাকা পেতাম বলে আস্তে আস্তে গল্প লেখায় চর্চা কমে গেল। তার পরও বহু দিন উপন্যাস-প্রবন্ধ লিখেছি। পঞ্চাশের পরে সাহিত্য জগৎ থেকে আস্তে আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি। সাংবাদিকতা জীবনে অনেক পত্রিকাও সম্পাদনা করেছি। নিজের নামে নয়, নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে ‘সওগাত’ সম্পাদনা করেছি। ‘মোহাম্মদী’ সম্পাদনা করেছি। ‘দিলরুবা’ বলে মাসিক সম্পাদনা করেছি। ‘চাবুক’ নামের সাপ্তাহিক সম্পাদনা করেছি। এটি ইত্তেফাকের পাবলিকেশন ছিল। দৈনিক জনপদের প্রধান সম্পাদক ছিলাম। বিলেতে গিয়েও নতুন দিন, পূর্বদেশ, নতুন দেশ ইত্যাদি কাগজ সম্পাদনা করেছি। সাংবাদিকতা সূত্রেই আমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালে তখন অবজারভার হাউসের দৈনিক পূর্বদেশে কাজ করি। পূর্বদেশের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আগরতলা চলে গেলাম। মাসখানেক পর কলকাতায় গিয়ে ‘জয় বাংলা’ কাগজের নির্বাহী সম্পাদক হলাম। এটি মুজিবনগর সরকারের অফিশিয়াল মুখপত্র ছিল। সেই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও যুক্ত ছিলাম। জয় বাংলার লেখকরা সবাই ছদ্মনাম নিয়েছিলেন, আমি নাম বদলাইনি। যেমন প্রফেসর গোলাম মোর্শেদ ‘হাসান মোর্শেদ’ নামে লিখতেন। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতাম, একই সঙ্গে যুগান্তর-আনন্দবাজারে লিখতাম। মোটামুটি ভালোই চলে যেত। দেশ মুক্ত হওয়ার পর ফিরে এসে জনপদের সম্পাদক হলাম।

কলকাতায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কথা এখনো মনে আছে। আগে থেকেই তো রুদ্ধশ্বাস অবস্থা ছিল। প্রতিদিনই জেনারেল অরোরা ঘোষণা করছিলেন, চরমপত্র দিচ্ছিলেন যে আত্মসমর্পণ করো, না হয়... এই করতে করতে ১৬ তারিখে খুব সকালে খবর প্রচারিত হলো, পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। সেদিনই তাজউদ্দীন সাহেবের অর্ডার হলো, ‘জয় বাংলা’র বিশেষ সংখ্যা বের করতে হবে। দৌড়াদৌড়ি করে... কলকাতা শহরের তখন এমন অবস্থা— জয় বাংলা বললে ট্যাক্সিওয়ালা পয়সা নেয় না, ট্রামে ভাড়া নেয় না, বাসে পয়সা নেয় না, রেস্টুরেন্টে ঢুকলে বিল নেয় না। (হাসি) জয় বাংলা বললেই সব ফ্রি; এক দৌড়ে ট্যাক্সি নিয়ে প্রেস ঠিক করে জয় বাংলার বিশেষ সংখ্যা বের করার জন্য মানিকতলা গেলাম। তাজউদ্দীন সাহেব, নজরুল ইসলাম সাহেব, ওসমানীর বাণী নিয়ে সেদিনই বিশেষ সংখ্যা বের করেছিলাম। এটি আমার একটি বড় গৌরব। সেখানে আমারও কবিতা আছে ‘ঢাকায় ফিরছি’।

ঢাকায় ফিরে আসার পর এখান থেকে আবার জয় বাংলা সাপ্তাহিক হিসেবে বের করেছিল, আমি সম্পাদক। তারপর বঙ্গবন্ধু ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তোমাকে শেখ মণি খুব পছন্দ করে, বাংলার বাণীতে জয়েন করো।’ জয়েন করলাম। পরে রিজাইন করে কিছু দিন ঘরে বসে থাকলাম। তখন ফ্রিল্যান্স কলাম লিখতাম। আবদুল গণি হাজারী ভাই বেঁচে ছিলেন, তিনি ডেকে নিয়ে বললেন, ‘কামরুজ্জামান সাহেব দৈনিক জনপদ বের করবেন। জনপদের এডিটর হও।’ জনপদ অর্গানাইজ করলাম। কামাল লোহানীকে নিউজ এডিটর করলাম, আরও অনেকেই ছিলেন। এডিটর থাকার সময়েই স্ত্রী অসুস্থ হলেন। তাঁকে নিয়ে বিলেতে চলে গেলাম।

আমার জীবনের একটি বড় অধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য। আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জেলে ছিলাম, তাঁর সঙ্গে সারা বাংলাদেশ ঘুরেছি, আলজেরিয়া, অন্যান্য দেশেও গিয়েছি। হৃদয়টি বিশাল বলে সব সময় তাঁকে ভালোবাসি। সব বলার দরকার নেই, একটি ঘটনাই বলব— যখন জেলে ছিলাম, আমাদের সঙ্গে ক্লাস ফাইভের একটি ছাত্রও ছিল। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যোগদানের জন্য তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। সে জেলের ভাত খেতে পারত না, খালি কাঁদত। এক থালা ভাত, ভিতরে মরিচের গুঁড়া, ডালের পানি তো বুড়িগঙ্গার পানির মতো, গোশতের টুকরাটি দুরবিন দিয়ে দেখতে হয়। (হাসি)— এই ছিল খাবার। এ নিয়ে খুব বিক্ষোভ হলো। ছেলেটির কথা যখন বঙ্গবন্ধু শুনলেন, বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে তাঁর জন্য যে খাবার যেত, নিজে খেয়ে বাকিটুকু তার জন্য রোজ পাঠিয়ে দিতেন। ছেলেটি সে খাবার খেত। সব সময় দেখেছি, কোনো বিশেষ খাবার গেলে তিনি আজকে আমাকে, কালকে অমুককে এভাবে ভাগ করে পাঠিয়ে দিতেন। এই ছিল তাঁর বিরাট হৃদয়।

আমার সাংবাদিক বন্ধুদের কথা বলে শেষ করা যাবে না। ওয়াহিদুল হক ছিল সত্যিকারের এক হীরকখণ্ড, একই সঙ্গে রবীন্দ্রপ্রেমী আবার প্রগতিশীল। ১৯৪৮-৪৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি যখন রবীন্দ্রনাথবিরোধী মুভমেন্ট করে; তাঁর মূর্তি ভাঙে, তাঁর গান গাওয়া যাবে না— কমিউনিস্ট হওয়া সত্ত্বেও ওয়াহিদুল হক এসবের বিরোধিতা করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টি ফতোয়া দিল— ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’ গানটি গাওয়া যাবে না, কারণ এটি বিচ্ছিন্নতার গান। আমাদের হলো জনসংগ্রামের গান, রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়াদের কবি। এভাবে যখন তারা রবীন্দ্রনিধন করছে, ওয়াহিদুল কঠোরভাবে প্রতিবাদ করেছেন। এম আর আখতার মুকুলের বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা ছিল। মূসা, এবিএম মূসা যদিও হামিদুল হক চৌধুরীর কাগজে কাজ করেছেন, তবে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান— হামিদুল হকের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, সাহস করে তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নিউজটি প্রথম ছেপেছিল, ফলে হইচই পড়ে গিয়েছিল। অবজারভার যদি সেদিন ওই নিউজ না ছাপত, তাহলে আগরতলা কেসের কথা কেউ জানত না। গোপনেই তাঁদের ফাঁসি দিত। ফয়েজ আহমদ সব সময় বামপন্থি হলেও ব্যক্তিগতভাবে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগী ছিল।

আমার সাংবাদিক জীবনে আরও কত মধুর স্মৃতি। প্রেস ক্লাবে মওলানা আকরম খাঁকে বক্তৃতা দিতে দেখেছি। আইয়ুব খান যখন প্রেস অর্ডিন্যান্স করেন, তাঁর বিরুদ্ধে বিরাট প্রসেশন হয়, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আকরম খাঁ। তাঁকে বহনকারী গাড়িটি মূসা চালিয়েছে। তিনি বনেট ধরে দাঁড়িয়ে উর্দুতে স্লোগান দিয়েছিলেন। পেছনের সারিতে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, সালাম সাহেব, আজাদের সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন হাঁটছেন। মূসার গাড়িটি ছিল ভাঙা গাড়ি। মওলানা হাঁটতে পারেন না, তাঁকে কোলে করে গাড়িতে তোলা হয়েছিল। প্রেস ক্লাবের বক্তৃতায় মওলানা সাহেব ‘তোদের বাঁধন যত শক্ত হবে, মোদের বাঁধন টুটবে’— কবিতাটি আবৃত্তি করলেন। প্রেস ক্লাবেই পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের প্রগতিশীল তরুণ সাহিত্যিকদের মিটিং হয়েছিল। আকরম খাঁ তো প্রতিক্রিয়াশীল-সাম্প্রদায়িক হিসেবে পরিচিত, তখন বলা হলো, কমিউনিস্টদের সাহিত্য থেকে বাদ দাও, ওরা নাস্তিক। এখনো ওদের নাস্তিক বলে, তখনো বলত। আকরম খাঁ সেখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন, মুখস্থ হয়ে গেছে— ‘নিরীশ্বরবাদ যদি প্রকৃত বাণী মূর্তি ধারণ করে, তাহাকেও আমাদের সাহিত্যে গ্রহণ করিতে হইবে।’

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের সংস্পর্শেও এসেছি আমি। আমরা লেখা দিতাম, পছন্দ না হলে মানিক মিয়া একটি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে ‘কী লিখেছেন এগুলো’ বলে ফেলে দিতেন। আবার লিখতে হতো। তাঁর কাছেই সাংবাদিকতা শিখেছি, হি ওয়াজ অ্যা মাস্টার রাইটার। মওলানা আকরম খাঁ ছিলেন অন্য রকম। প্রতিদিন অফিসে আসতেন, বসতেন। তাঁর স্টাফ মানে সাংবাদিকদের চেয়ে তিনি অনেক বেশি প্রগতিশীল ছিলেন। হি ওয়াজ দ্য মোস্ট প্রোগ্রেসিভ জার্নালিস্ট কিন্তু পলিটিক্সে প্রতিক্রিয়াশীল ছিলেন। তবে খুবই ভালো মানুষ, অসাধারণ মানুষ ছিলেন।

সাহিত্য দিয়ে জীবন শুরু হলেও সাহিত্যে থিতু হতে পারিনি, এ জন্য মনে এক ধরনের আফসোস আছে।  আবার গৌরবও আছে। গৌরবটি এই যে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাপারে যেমন— প্রতিক্রিয়াশীল সাংবাদিকতা, মৌলবাদ এসব যখন এখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে যে সাহসের সঙ্গে লিখতে পেরেছি, এটি আমার একটি গৌরব বলে মনে করি। মনে করি যে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করেছি। আবার দুঃখও হয়— সাহিত্যের সঙ্গে থাকলে অন্তত কিছু লেখা হতো। কিছু লেখা তো মানুষের মনে থাকত, কিছু চরিত্র তৈরি করে যেতে পারতাম, দেশের কিছু ভূচিত্র আঁকতে পারতাম।  সেগুলো আমি করতে পারিনি, অনেকে করেছেন। তবে মনে হয়, হয়তো অনেকের চেয়ে অনেক ভালোভাবে এসব করতে পারতাম। সেই দুঃখ তো মনে আছেই।

 

লেখক : বরেণ্য সাংবাদিক।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর