অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটেছিল হিটলারের জমানায়। হাজার বছরের জার্মান সংস্কৃতি যেভাবে জাতিটিকে সারা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতর আর্য জাতিগোষ্ঠীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, তা ১৯৪০ সালের দিকে নাৎসিবাদের খপ্পরে পড়ে রীতিমতো মূর্খের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়। নাৎসি পুলিশ দেশের নামকরা কবি-সাহিত্যিক-দার্শনিক-রাষ্ট্রচিন্তক এবং মুক্তবুদ্ধির সাহসী মানুষকে পাইকারি হারে জেলে ঢোকাতে থাকে, যাদের মধ্যে দার্শনিক ডিয়েটরিস বোন হোয়েফারও ছিলেন। ১৯৪৩ সালে জেলে থাকা অবস্থায় তিনি গণমূর্খতা, মবসংস্কৃতি এবং কর্তৃত্ববাদী অপশাসন নিয়ে যে দুনিয়াকাঁপানো দার্শনিক তত্ত্ব রচনা করেছিলেন, তা আজ সংক্ষিপ্ত আকারে আপনাদের কাছে পেশ করব।
কারাবন্দি বোন হোয়েফার চিন্তা করতে থাকেন কেন জার্মানির এত অধঃপতন হলো, কেন জার্মান জাতির চিন্তার শক্তি হ্রাস পেল। তারা বিকল্প চিন্তা, বিকল্প কর্ম, বিকল্প রাজনীতি বাদ দিয়ে কেন নাৎসিবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করল এবং অ্যাডলফ হিটলারের সব কথা, কর্ম, নির্দেশ মাথা নত করে মেনে নিতে অভ্যস্ত হলো? অথচ রেনেসাঁ-পরবর্তী আধুনিকতা, বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের কিংবদন্তি আবিষ্কার, সংগীত, অর্থশাস্ত্র এবং রাজনীতিতে জার্মান জাতি যে উন্নতি করেছিল তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী এক হাজার বছরে পৃথিবীর অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠী করতে পারেনি।
জার্মান জাতি গঠনে যেসব মহামানব ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন, তাদের জীবন ও কর্ম নিয়ে বোন হোয়েফার গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। বিশ্বের প্রথম জুতো আবিষ্কার থেকে শুরু করে পেট্রোল ইঞ্জিন, ডিজেল ইঞ্জিন, ছাপাখানার মেশিন ইত্যাদির নাম এলে যেমন জার্মানির কথা মনে পড়বে তেমনি সংগীতে বিটোফেন, দর্শনে ইমানুয়েল ফার্স্ট, কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিখ নিটসে হেগেল, আর্থার শোপেন হাওয়ার প্রমুখ ছাড়াও বিজ্ঞানে আলবার্ট আইনস্টাইনের সঙ্গে সাহিত্যিক গেসট, টমাস মান, হারমান হেসে প্রমুখের অবদান তাবৎ দুনিয়ার সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সুতরাং সেই জার্মানি কেন নাৎসিবাদের কবলে পড়ল?
কনডেম সেলে বসে উল্লিখিত বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে গিয়ে বোন হোয়েফার দেখলেন যে মানুষের মূল সমস্যা তার খারাপ স্বভাব কিংবা অশুভ চিন্তা নয়, বরং তার মূর্খতা, নির্বুদ্ধিতা এবং জ্ঞানহীনতার কারণে সে একসময় ভীরু-কাপুরুষ-দুর্নীতিবাজ, জুলুমবাজ ও নির্মম নিষ্ঠুর প্রাণীতে রূপান্তরিত হয়। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় মূর্খতা ভাইরাস আকারে ছড়াতে ছড়াতে একসময় গণমূর্খতায় রূপ নেয়। এ অবস্থায় মানুষ পরিশ্রম করে উপার্জনের চেয়ে চুরি, ডাকাতি, মববাজি, লোক ঠকানোকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে। শ্রম-সাধনা-চিন্তার পথ পরিহার করে লোভের রাজ্যে প্রবেশ করে এবং ঠগবাজির মাধ্যমে সবকিছু হাসিলের জন্য চূড়ান্ত ঝুঁকি নিতে আরম্ভ করে।
গণমূর্খতার চূড়ান্ত পর্যায়ে মানুষ কীভাবে নিজেদের স্বৈরাচারী শাসকের চরণে নিবেদন করে এবং মূর্খদের একাংশ কীভাবে স্বৈরাচারের দোসর বা স্বৈরাচারী শাসনের ভয়ংকর হাতিয়ারে পরিণত হয়, তা বর্ণনা করতে গিয়ে বোন হোয়েফার বলেন, মানুষ তীব্র মানসিক চাপ এবং সামাজিক সংকটে এবং তীব্র প্রয়োজনের সময় স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় নিজেদের অজান্তে তারা তাদের সহায়সম্পত্তি, জীবন-যৌবন, মানসম্মান, অন্যের চিন্তা ও সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়। বিশেষ করে যাদের পেশিশক্তি, রাষ্ট্রশক্তি এবং অর্থশক্তি মূর্খদের চেয়ে অনেক বেশি থাকে, তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য মূর্খের দল একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে স্বৈরাচারী বিধিব্যবস্থার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হওয়ার জন্য চেষ্টা-তদবির শুরু করে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র সমাজে দুটি অদ্ভুত রসায়ন তৈরি হয়ে যায়-
প্রথমত শাসকরা বুঝে যায় যে জনগণ মূর্খ হয়ে পড়েছে। তারা সত্য কথা শোনার চেয়ে রূপকথার গল্প শুনতে পছন্দ করে এবং অবোধ শিশুদের যেভাবে মিথ্যা ভয়-আতঙ্ক কিংবা লোভ-লালসার গল্প বলে প্রতারণা করা যায়, তেমনই মূর্খ জনগোষ্ঠীকে লাঠি, গুলি টিয়ার শেলের ভয় দেখিয়ে সবকিছু হাসিল করা সম্ভব। অন্যদিকে তাদের যার যার অবস্থানে থেকে মবসৃষ্টি, জুলুম অত্যাচার করার অবাধ স্বাধীনতা এবং বিচারহীনতার গ্যারান্টি দিলে একদল লোক স্বৈরাচারের ভয়ানক দোসর এবং নির্মম-নিষ্ঠুর হাতিয়ারে পরিণত হয়ে যায়। আর অন্য দলটি নির্যাতিত হতে হতে ক্রমশ মূর্খতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে এবং কথাকর্মে স্বৈরাচারের প্রতিবাদ না করাটাকে রাজধর্ম হিসেবে ধ্যানজ্ঞান করে।
দ্বিতীয়ত রসায়ন ঘটে- মূর্খ জনগণ ও স্বৈরাচারের দোসর মববাজদের মধ্যে মববাজরা মনে করে তাদের পেছনে শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তি রয়েছে এবং তারা যা কিছু করছে তার জন্য কোনো বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না। ভুক্তভোগীরা মনে করে যে জালেমদের পেছনে রাষ্ট্রশক্তির হাত বা আশকারা রয়েছে। সুতরাং প্রতিবাদে বিপদ বাড়বে। সে ক্ষেত্রে জুলুম মেনে নেওয়া এবং জুলুমবাজদের কাছে আত্মসমর্পণ করাটাই গণমূর্খের সমাজ ও রাষ্ট্রে জনপ্রিয় প্রথাতে পরিণত হয়।
বোন হোয়েফারের উল্লিখিত সূত্রের আলোকে ১৯৬০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টানলি মিলিগ্রাম একটি জরিপ পরিচালনা করেন। জরিপের মাধ্যমে তিনি একটি প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করেন। প্রশ্নটি হলো, একটি মানুষ তার উপরস্থ ব্যক্তির নির্দেশ কতটা মানতে প্রস্তুত! এমনকি নির্দেশটি যদি অন্যায়-বিপজ্জনক এবং মৃত্যুঝুঁকিসংক্রান্ত হয় তবু মানুষ কেন নির্দ্বিধায় তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হুকুম তামিল করে? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য স্টানলি মিলিগ্রাম নিম্নরূপ পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
একদল শিক্ষার্থীর সামনে কতিপয় প্রশ্ন রাখা হয় এবং বলা হয় তারা যে চেয়ারে বসা রয়েছে সেখানে প্রতিটি ভুল উত্তরের জন্য ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা রয়েছে। কোনো শিক্ষার্থী যদি বারবার ভুল করতে থাকে, তবে প্রতিবার ইলেকট্রিক শকের মাত্রা বাড়বে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শেষ ভুলের জন্য যে শক দেওয়া হবে তাতে শিক্ষার্থীর মৃত্যু হবে। এই জরিপের অন্তরালে প্রফেসর মিলিগ্রাম দুটো ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। প্রথমত ভুল উত্তরের জন্য একটি শব্দ এবং ইলেকট্রিক শক আরম্ভ হচ্ছে এমন একটি শব্দ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কোনো ইলেকট্রিক শকের ব্যবস্থা ছিল না। দ্বিতীয়ত শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা করার জন্য একজন নকল বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছিলেন, যিনি প্রতিটি প্রশ্নের জবাব শিখিয়ে দিতেন।
উল্লিখিত জরিপের সময় দেখা গেল, শিক্ষার্থীরা নিজেরা কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাহায্যকারী নকল বিশেষজ্ঞের শিখিয়ে দেওয়া উত্তর দিচ্ছেন এবং একই সময়ে ভুল উত্তর এবং ইলেকট্রিক শকের আওয়াজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীরা আতঙ্ক ও যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠছেন। যদিও প্রকৃত পক্ষে ইলেকট্রিক শকের আওয়াজ ছাড়া কিছুই ছিল না। ছাত্ররা প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজেরা চেষ্টা না করে বারবার বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ভুল করে চলছিলেন এবং যেভাবে ইলেকট্রিক শকের মাত্রা ও তীব্রতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইলেকট্রিক শকের আওয়াজ শুনে পর্যায়ক্রমে চিৎকার-চেঁচামেচি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি শেষ প্রশ্ন যেটার ভুল উত্তরে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত ছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও তারা বারবার প্রতারিত এবং বারবার শাস্তির তীব্রতা বাড়লেও চূড়ান্ত পর্যায়ে একই ভুল করেছিলেন। অর্থাৎ নকল বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ভুল উত্তর দিয়েছিলেন। আমরা যদি উল্লিখিত জরিপের ফলাফল এবং বোন হোয়েফারের গণমূর্খতার দার্শনিক-তত্ত্বের সম্মিলন ঘটিয়ে একটি সারাংশ তৈরি করি, তবে নিম্নরূপ ফলাফল পাব।
১. শিক্ষার্থীদের যখন ইলেকট্রিক চেয়ারে বসানো হয় এবং তাদের ভুল জবাবের পরিণতি বলা হয় তখন ভয়-আতঙ্কে তাদের চিন্তাশক্তি রহিত হয়- জ্ঞানের দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা নিজেদের অজান্তে সাহায্যকারী খুঁজতে থাকেন।
২. নকল বিশেষজ্ঞ যখন একের পর এক ভুল উত্তর দিচ্ছিলেন তখন তা অনুধাবন-মূল্যায়ন এবং পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে হিম্মত তা শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলেছিলেন।
৩. প্রথম ভুল উত্তরের পর তারা নকল ইলেকট্রিক শক খেয়ে চিৎকার করেছিলেন এবং গণমূর্খতার সূত্রের আলোকে ক্রমশ অন্ধকার মূর্খতার দিকে এগোচ্ছিলেন এবং শেষ প্রশ্নে মৃত্যু নিশ্চিত জানা সত্ত্বেও তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। কারণ প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তারা যে প্রতারক বিশেষজ্ঞের কবলে পড়েছিলেন তা অনুধাবন করার শক্তি তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় অথবা শেষ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলছিলেন।
উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা উপসংহারে এ কথা বলতে পারি যে স্বৈরাচারী শাসকরা কৃত্রিম সংকট, ভয়-আতঙ্ক তৈরি করে মানুষের চিন্তার দরজা বন্ধ করে দেয়। অসহায় মানুষ যখন ছোটাছুটি করতে থাকে, তখন তারা দোসরদের হুকুম করে আর জনগণকে বাধ্য করে তাদের এবং তাদের দোসরদের সবকিছু প্রশ্ন ছাড়া মেনে নেওয়ার জন্য। আর এভাবেই গণমূর্খতার কবলে পড়ে একটি জাতি মববাজি, মবভাই, চান্দাভাই, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ইত্যাদিকে চোখ বুজে হজম করে।
পাদটীকা : এইচ-এ এইচ ইউটিউব চ্যানেল দ্বারা অনুপ্রাণিত
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক