হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুশয্যায় শায়িত, কিন্তু তাঁর জবান থেকে কলমা বের হচ্ছে না। সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমীপে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রসুল! আলকামা মৃত্যুর প্রহর গুনছে! অথচ শতচেষ্টার পরও তাঁর জবানে কলমা উচ্চারিত হচ্ছে না। দয়ার নবী আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে স্বয়ং চেষ্টা করলেন। আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুর জবান থেকে সব কথা বের হয়, কলমা উচ্চারিত হয় না। নবীজি চিন্তায় পড়ে গেলেন এবং কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে চক্ষু বন্ধ করে বসে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। ব্যাপারটা কী? অতঃপর প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুর মাকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আলকামার জবান থেকে কলমা বের হচ্ছে না কেন, সে কি কোনো অন্যায় করেছে? হজরত আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুর মা বললেন, আমার আলকামা সোনার ছেলে, সে খুব নামাজি, দানবীর, গরিবের বন্ধু, হালাল-হারাম মেনে চলে, এক কথায় সে সব মহৎগুণের অধিকারী, এমন সুসন্তান খুবই বিরল। অতঃপর রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আলকামার প্রতি সন্তুষ্ট নাকি অসন্তুষ্ট? জবাবে তিনি বললেন, আমি তার প্রতি অসন্তুষ্ট। আলকামা বিবাহ করার আগে আমার অনেক আপন ছিল, বিবাহের পর থেকে এ পর্যন্ত আমি তার আচরণে ব্যথিত। এর জবাব শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যস, যথেষ্ট! আমার আর কোনো কথা শোনার প্রয়োজন নেই। আচ্ছা বল তো, তোমার ছেলে বেইমান হয়ে জাহান্নামে যাক, এটা কি তুমি চাও? যদি তা-ই হয়, তাহলে এখনই তাকে আগুনে জ্বালিয়ে শেষ করে দিই। আর যদি তুমি তোমার ছেলের মঙ্গল ও কল্যাণ চাও, তাহলে তাকে ক্ষমা করে দাও। তা না হলে তার মৃত্যু বেইমান অবস্থায় হবে এবং তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সতর্কবাণী শুনে আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুর মা তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন।
ক্ষমার উপকারিতা
কষ্ট পেয়ে ক্ষমা করলেও অন্তরে ব্যথা থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আপনি আমার মাথায় আঘাত করলেন, যার কারণে মাথা রক্তাক্ত হয়ে গেল। অতঃপর আপনি আমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিলাম। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, কেউ যদি তোমার কাছে ক্ষমা চায় তবে তাকে ক্ষমা করে দাও। এর ফলে আল্লাহপাকও তোমাকে হাশরের দিন ক্ষমা করে দেবেন। কিন্তু ক্ষমা করার পরও রক্তাক্ত করার ব্যথা অন্তরে থেকে যায়। তাহলে ক্ষমার দ্বারা কী লাভ? ক্ষমার দ্বারা লাভ হলো এই যে হাশরের দিন এ অপরাধের বিচার হবে না। তবে আমাকে রক্তাক্ত করার কারণে আমার ছেলে-মেয়ে, পিতা-মাতা ও আত্মীয়স্বজন যে ব্যথিত হয়েছে- এটা একটা মারাত্মক ব্যাপার।
আরেকটি উদাহরণ
হজরত ওয়ার্শি রাজিয়াল্লাহু আনহু তখনো কাফের। ওহুদের যুদ্ধে তিনি হজরত হামজা রাজিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করেন। হজরত হামজা রাজিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ইসলামের এক সুদৃঢ় পাহাড়, যার শাহাদাতে মুসলমানরা এক বিরাট শক্তি হারান। হজরত হামজা রাজিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতে হজরত রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত মর্মাহত হন। কারণ একদিকে হজরত হামজা রাজিয়াল্লাহু আনহু ছিলেন ইসলামের সুদৃঢ় প্রাচীর। দ্বিতীয়ত তিনি ছিলেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা ও দুধভাই। হজরত হামজা রাজিয়াল্লাহু আনহুকে হত্যা করার কিছুদিন পর হজরত ওয়াশি রাজিয়াল্লাহু আনহু স্বেচ্ছায় নবীজির দরবারে হাজির হয়ে কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে যান এবং নবীজির ধারেকাছে অবস্থান করতে থাকেন। এভাবে কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজরত ওয়াশি রাজিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বললেন, হে ওয়াশি! তুমি যদি আমার কাছে না আসতে, তাহলে খুব ভালো হতো। কারণ তুমি আমার কাছে এলে তোমাকে দেখে আমার প্রিয় চাচা হামজার শাহাদাতের কথা মনে হয়। তখন আমার অন্তরে অত্যন্ত ব্যথা অনুভব হয়। আমার অন্তরের ব্যথায় তোমার কোনো ক্ষতি হয়ে যায় কিনা! তাই তুমি আমার সঙ্গে কম সাক্ষাৎ করতে আসবে। এরপর তিনি সিরিয়াতে চলে যান এবং সেখানে মৃত্যু পর্যন্ত দীন-ধর্মের আঞ্জাম দিয়েছেন। কোনো দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেননি। যা হোক, হজরত আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুর মা তাঁকে ক্ষমা করে দিলেন। অতঃপর নবীজি হজরত আলকামা রাজিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, কলমা পড়। এবার নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জবানে জারি হয়ে গেল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ। কলমা পড়া শেষে তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মাণ হলো- নবীর উপস্থিতিতে সাহাবি হওয়া সত্ত্বেও মায়ের অসন্তুষ্টির কারণে জবানে কলমা উচ্চারিত হয় না।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ