রবিবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

অজানা কষ্ট রাজা-বাদশাহদেরও দাহ করে

নঈম নিজাম

অজানা কষ্ট রাজা-বাদশাহদেরও দাহ করে

কবি নজরুল লিখেছেন, ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়/আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়/...মহারাজ শ্রীহরিশচন্দ্র রাজ্যদান ক’রে শেষ/শ্মশান-রক্ষী হয়ে লভিল চণ্ডাল বেশ/বিষ্ণু বুকে চরণ-চিহ্ন, ললাট-লেখা কে খণ্ডায়।’ ভারতের শেষ সম্রাট ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফর। সম্রাট বাবর, আকবর, জাহাঙ্গীরের উত্তরাধিকার। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন একজন কবি। আরাম-আয়েশের জীবন ছিল পছন্দ। যুদ্ধ ভালো লাগত না। ঝামেলা পছন্দ হতো না। দুই লাইন কবিতা লেখাতেই ছিল নেশা। সেই নেশা কঠিন দুঃসময়েও কমেনি। মৃত্যুর আগেও এমনকি লিখে গিয়েছেন নিজের আক্ষেপ ও দুঃখের কথা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশের আগ্রাসী অবস্থান দেখে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবু নিস্তার পাননি। সিপাহি বিদ্রোহের সময় ভারতীয়রা তাঁকে ঘিরে আবার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন হয়ে দাঁড়াল কাল। ইংরেজদের হাতে আটক হলেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর। খুঁজে খুঁজে বের করে তাঁর সন্তানদের হত্যা করা হয়। স্ত্রী জিনাত মহলসহ বাহাদুর শাহকে নির্বাসনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইংরেজরা। চিরতরে দিল্লির শাসন থেকে বাবরের বংশধর মোগলদের উচ্ছেদেই এ পরিকল্পনা। মোগলদের প্রতি তখনো প্রজাদের আনুগত্য নিয়েই ছিল ভয়। যদিও দীর্ঘদিনের শাসনে তখন ক্লান্ত শেষ মোগল সম্রাট। ইংরেজদের ঠেকানোর কোনো অবস্থানই ছিল না তাঁর। সিপাহিরা তাঁর পক্ষে অবস্থান না নিলে ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো। কিন্তু নিয়তি বলে কথা! ৮৩ বছরের বৃদ্ধ সম্রাট বাহাদুর শাহ বন্দী হলেন। সন্তানদের বেশির ভাগ খুন হন। জীবিত দুই শাহজাদা ও দুই শাহজাদিকে নিয়ে সম্রাটকে বাধ্য করা হয় দিল্লি ছাড়তে। জাহাজে তুলে দেওয়া হয় রেঙ্গুনের পথে। ভয়ঙ্কর কষ্ট নিয়ে জাহাজে ওঠেন বাহাদুর শাহ। অনেক কষ্ট, দুর্ভোগ, অপমান নিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পৌঁছেন রেঙ্গুনে। ব্রিটিশ বাহিনীর ক্যাপ্টেন নেলসন ডেভিসের বাড়িতে শুরু হয় নতুন জীবন। নিয়তির করুণ পরিহাসে ওই বাড়ির গ্যারেজের ভিতরে ঠাঁই হয় হিন্দুস্তানের বাদশাহর।

বন্দীজীবনে সম্রাটকে থাকতে দেওয়া হয় একটি পাটের দড়ির খাটিয়ায়। চরম দুঃখ-কষ্টে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন। চলতে ফিরতে পারতেন না। চিকিৎসা হতো না। সম্রাটের সঙ্গে আসা পরিবারের সদস্যদের নীরব অশ্রুপাতে কাটত দিন। কিন্তু বেশিদিন নয়। কঠিন কষ্টের মাঝেই সম্রাট চিরবিদায় নেন ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর। গোপনীয়তার মাঝে লাশ দাফন করা হয়। মৃত্যুর খবরও ঠিকভাবে প্রচার করা হয়নি। ইংরেজদের ভয় ছিল ভারতবাসী খবর পেলে কবরে এসে ভিড় জমাবে। বাহাদুর শাহ আবারও জেগে উঠবেন। তাই গোপনীয়তার শেষ ছিল না। সম্রাটের স্ত্রী জিনাত মহল মারা যান ১৮৮৬ সালে। সম্রাটের পাশেই তাঁকে সমাহিত করা হয়। দীর্ঘদিন বাঁশের বেড়া দিয়ে কবরগুলো ঘিরে রাখা ছিল। বিশ শতকের শুরুর আগে ভারতীয়রা এই সমাধির সন্ধান পায়নি। ১৯০৩ সালের পর কবরে প্রথম ফাতিহা পাঠ করে শ্রদ্ধা নিবেদন শুরু হয় ভারতবর্ষের মানুষের। এখন সম্রাট বাহাদুর শাহের মাজার পর্যটকদের তীর্থস্থান। কয়েক বছর আগে আমি নিজেও গিয়েছিলাম সম্রাটের সমাধিতে। সমাধির দেয়ালে লেখা আছে তাঁর সেই দীর্ঘশ্বাস নিয়ে লেখা কবিতাটি। মনে হলো কে যেন আমাকে পড়ে শোনাচ্ছেন, ‘মরণেকে বাদ ইশ্ক মেরা বা আসর/হুয়া উড়নে লাগি হ্যায় খাক/মেরি ক্যোয়ি ইয়ার মে/কিতনা বদনসিব জাফর দাফনকে লিয়ে দোগজ/জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে।’ দিল্লিতে দাফনে একটুকরো জমি মেলেনি ভারতের বাদশাহর জন্য। বাহাদুর শাহের এই কষ্ট, এই বেদনা, আক্ষেপের জবাব দিয়েছিলেন অনেক দিন পর ভারতের একজন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর নাম রাজীব গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তিনি বার্মা (মিয়ানমার) সফরে যান। তারপর শ্রদ্ধা জানাতে যান বাহাদুর শাহের মাজারে। এই লেখা পড়ে তিনি দুঃখ পান। বেদনার আঘাতেই পরিদর্শক বইতে লিখেন, ‘দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে/পার তেরি কোরবানি সে উঠি আজাদি কি আওয়াজ/বদনসিব তো নাহি জাফর/জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত মে/আজাদি কি পয়গাম সে।’ অর্থাৎ ‘হিন্দুস্তানে তুমি দুই গজ মাটি পাওনি সত্য, তবে তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে।’

মানুষের কষ্টের কোনো শেষ নেই। বাদশাহ থেকে গরিব সবার ভিতরে আরেকটা মানুষ বাস করে। বাইরে থেকে একরকম মনে হলেও মানুষের ভিতরে আরেকটা জগৎ থাকে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান থেকে রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সবার কষ্টগুলো তাঁরা নিজের মতো ব্যক্ত করে গেছেন। আবার মার্গারেট থ্যাচার, ইন্দিরা গান্ধী নিজের দুঃখগুলোকে আড়ালেই রাখতেন। শুধু পুত্র সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর সময় হাসপাতালে ভেঙে পড়েন ইন্দিরা। তবু মিডিয়া আর মানুষের সামনে তা তুলে ধরেননি। শুধু নিজের চোখের অশ্রু আড়াল করতে চোখ মুছে কালো সানগ্লাসের আড়ালে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করেন। দুনিয়ার কঠোরতম মানুষের ভিতরে থেকে যায় অনেক অজানা কষ্ট। সেই বেদনার নীল রং কখনো সামনে আসে আবার কখনো আড়ালে থেকে যায়। দুনিয়ার মানুষের কাছে থেকে যায় শুধু তাঁদের কঠোরতাই। ব্রিটেনের দাপুটে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মার্গারেট থ্যাচার। ১৯৯০ সালের ২৮ নভেম্বর ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন তিনি। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় তাঁর চোখে ছিল অশ্রু। বিশ্ব অবাক চোখে দেখল লৌহমানবীর অশ্রু ঝরছে ঝরঝর করে। সবাই বিস্ময় নিয়ে তাকাল, ভাবল লৌহমানবী কি কাঁদতে পারেন? মার্গারেট থ্যাচারকে লৌহমানবী হিসেবে চেনে বিশ্ববাসী। ১৯৮২ সালে ফকল্যান্ড দ্বীপ দখল করে আর্জেন্টিনা। বিনা রক্তপাতে ফকল্যান্ড দ্বীপ পুনর্দখল করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠেন মার্গারেট। কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ তাঁর সর্বনাশ ডেকে আনে। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা হ্রাসের চেষ্টা করেন তিনি। একই সঙ্গে বেসরকারিকরণের দিকে ঝোঁকেন। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে বদলাতেই ছিল তাঁর চেষ্টা। কিন্তু এ বিষয়টি শ্রমিকরা ভালোভাবে নেয়নি। শুরু হয় আন্দোলন। অন্যদিকে পেছনে যেতে নারাজ লৌহমানবী। এ নিয়ে একটি সিনেমা আছে ‘আয়রন লেডি’। ছবিটি দেখেছিলাম অনেকদিন আগে। মার্গারেট থ্যাচারের শেষ সময়টা উঠে আসে এ ছবিতে। নিঃসঙ্গতা বেরিয়ে আসে ক্ষমতা ছাড়ার পর। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিমান নিয়ে আরেকটি ছবি দেখেছিলাম ‘এয়ারফোর্স ওয়ান’। সোভিয়েত বিভক্তির কাহিনি, বিদ্রোহীদের কার্যক্রম ও আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে কিডন্যাপের চেষ্টা নিয়ে ছবিটি অনেকদিন আগে নির্মিত। ছবিটি প্রথমে দেখেছিলাম সানু মিয়ার লন্ডনের বাড়িতে বসে। সেই সানু ঢাকায় এসে হঠাৎ চলে গেলেন। বারডেমে যখন দেখতে গেলাম। সবাই বলল, ভাই, লাশ বাইরে রাখা। মুহূর্তেই মানুষটার নাম বদলে ‘লাশ’ হয়ে গেল!

ভালো মানুষ বেশিদিন থাকেন না। চলে যান। দুনিয়ার অশান্তি তাঁদের ভালো লাগে না। তাই তাঁরা চলে যান। প্রিয়জনদের মৃত্যু আমাকে কাঁদায়। বাবার মৃত্যুর সময় পাশে ছিলাম। তিনি কী যেন বলতে চেয়েছিলেন, বলতে পারেননি। ডাক্তার এলেন, ইনজেকশন দিলেন। তারপর বাবা চোখ বুজলেন। বন্ধু ডা. লিটুর কত আর বয়স হয়েছিল? কেন তাঁকে হুট করে বিদায় নিতে হবে? ৬২ বছরে বিদায় নিয়েছিলেন স্বপ্নবাজ উন্নয়ন ব্যক্তিত্ব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে মানুষটার কী সমস্যা হতো? ডাক পড়লে সবাইকে চলে যেতে হয়। আমরা কেউই থাকব না। প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর আগে লেখাগুলোতে অনেক আক্ষেপ দেখেছি। কষ্ট দেখেছি। অশ্রু দেখেছি। মেয়েদের নিয়ে স্মৃতি দেখেছি। মানুষ কি শেষ বিদায়টা টের পায়? মেজর জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর আগে একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। তাঁর চোখে-মুখে বেঁচে থাকার আকুতি দেখেছিলাম। চেয়েছিলেন সিঙ্গাপুর গিয়ে চিকিৎসা নিতে, হয়নি। বাচ্চারা নিয়ে গেল ভারতে। দেশে ফিরলেন। কিছুদিন পর চলে গেলেন। এই ধনসম্পদ কিছুই নিয়ে যাননি। একাই চলে গেলেন। গুলশান মসজিদে তাঁর জানাজায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, মানুষের এত কিছু করে কী লাভ? কোনো কিছুই তো কেউ নিয়ে যায় না। একটুকরো সাদা কাফনের কাপড়ই সঙ্গে থাকে। তার পরও কেন এত লড়াই? সবকিছু চলে যায়। মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা লিখতে ভালো লাগে না। শচীন দেববর্মণের একটি গান আছে, ‘তুমি আর নেই সে তুমি... জানি না জানি না কেন এমনও হয়...’ আসলেও কেন এমন হয়? এখনো মাঝে মাঝে আমার ঘুম ভাঙে বাবা কী বলতে চেয়েছিলেন? বাবাকে স্বপ্ন দেখি। তিনি আমার পাশে এসে দাঁড়ান। তারপর ডাকেন, চল ঘুরে আসি। চল ঘুরে আসি বাবা...। প্রতিযোগিতার এই দুনিয়ায় সস্তা মানুষের সংখ্যাই বাড়ছে। কেউই বুঝতে পারছে না আজ আছি কাল নেই। চলে গেলে সব শেষ। আর কিছুই ফিরে আসবে না। এই জীবন ক্ষণস্থায়ী, বড্ড ঠুনকো। লিটু ছিলেন হৃদয়ের ডাক্তার। কেউ হার্ট অ্যাটাক করলে লিটুর কাছে পাঠিয়ে দিতাম। সেই লিটু গেলেন হৃদরোগে। হার্টের ডাক্তারও বুঝতে পারেননি নিজের হৃদয় আক্রান্তের কথা। হাসপাতালে গেলেন। তারপর সব শেষ। কবিগুরু লিখেছেন, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে... তবু প্রাণ নিত্যধরা, হাসে সূর্য চন্দ্র তারা...।’ মাঝে মাঝে অতীত আমাদের কাঁদায়। ছোট ছোট ভুলগুলো আমাদের শেষ করে দেয়। কষ্টের দাহ তীব্রতর হয়ে তছনছ করে দেয় অনেক কিছু। হঠাৎ করেই বর্তমান হয়ে ওঠে অতীত। বিষণ্নতা চেপে বসে বুকের ওপর। জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর আগে বার বার আক্ষেপ করেছিলেন বেঁচে থাকার জন্য। অথচ খামখেয়ালিপনাই তাঁকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সারা জীবনের কষ্টকে তিনি একবারে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন। না হলে ট্রামের নিচে কেউ পড়ে? তার পরও হাসপাতালের বেডে শুয়ে শেষ মুহূর্তে জীবনানন্দ দাশ পরিচিত ডাক্তারকে দেখে আশাবাদী হয়ে ওঠেন। বেঁচে থাকার আকুতি নিয়ে তারপর বলেন, কে বুবু? বুবু এসেছিস। বাঁচিয়ে দে...। শিশুর মতো অসহায় কণ্ঠ, বাঁচিয়ে দে ভাই...। জীবনানন্দ দাশকে কেউ বাঁচাতে পারেননি। এভাবে একদিন সবাই চলে যাব। কেউই থাকব না। এই দুনিয়া চিরস্থায়ী থাকার কোনো ঠিকানা নয়।

                লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর