এখন বাংলাদেশের মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রে রয়েছে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠক। পাঠক লেখাটি যখন পড়ছেন, তখন হয়তো আলোচনা চলছে অথবা আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। ইউনূস-তারেক ডায়ালগের ফলাফল সম্পর্কে কিছু খবরও হয়তো অনলাইনে ইতোমধ্যে এসে গিয়ে থাকবে। কিন্তু ভিতরের সব খবর কি এখনই পাওয়া যাবে? মনে হয় না। আলোচনার এজেন্ডা সম্পর্কেও আমরা জানি না। তবে কী কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে, পরিস্থিতিদৃষ্টে তা অনুমান করা যেতেই পারে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লন্ডন বৈঠকটি হতে পারে বাংলাদেশের রাজনীতির টার্নিং পয়েন্ট। এর মধ্য দিয়ে মোড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। কী ধরনের মোড় পরিবর্তন, সেটা বোঝা যাবে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে।
সরকারের কাছে বিএনপি নেতৃত্বের বড় চাওয়া হচ্ছে ডিসেম্বর বা তার আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করা। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধে ইলেকশন হবে বলে জানিয়েছেন। এ ঘোষণায় বিএনপি হতাশা ব্যক্ত করেছে। দলটি ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবিতে অনড়। কাজেই ইলেকশনের টাইম লাইন দুই নেতার আলোচনায় গুরুত্ব পাবে, এটা হচ্ছে দৃশ্যমান বাস্তবতার নিরিখ। এর নেপথ্যে আরও বেশি কিছু আলোচনায় থাকতে পারে। বিএনপির যেমন সরকারের কাছে চাওয়ার আছে তেমনই সরকারপ্রধানেরও বিএনপির সঙ্গে কিছু বিষয় মিটিয়ে নেওয়ার বিষয় থাকতে পারে। এগুলো হাইপোথিসিস মনে হলেও কিছু বাস্তব ভিত্তিও রয়েছে। লন্ডন আলোচনা সফল হয়েছে অথবা হয়নি-এ ধরনের খবর আজকেই পাওয়া যাবে। কিন্তু কোন বিষয়ে ঠিক কতটুকু সমঝোতা হয়েছে, তা জানতে এবং বুঝতে আমাদের মনোযোগী দৃষ্টি রাখতে হবে বিএনপি এবং এনসিপির টোন ও কর্মসূচির দিকে। বিএনপির বিপক্ষে এনসিপির কণ্ঠস্বর নমনীয় হলে এবং গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিটি যদি ধামাচাপা পড়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে সরকারপ্রধানের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আলোচনা পুরোপুরি সফল হয়েছে। ভালো একটা সমঝোতা হয়েছে-যা গণতন্ত্রের ভিত মজবুত করবে, দেশের জন্যও কল্যাণ বয়ে আনবে।
বিএনপির প্রতিশ্রুত নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকার এবং রিকনসিলিয়েশনের বিষয়টি দুই নেতার আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়ে থাকতে পারে। এগুলো প্রকাশিত খবরে না-ও আসতে পারে। রাজনীতিতে সদরে যা ঘটে এবং রটে, তার চেয়ে বেশি কিছু ঘটতে পারে অন্দরে। প্রকাশ্যে যা কিছু ঘটে তা তো দেখাই যায়। কিন্তু পর্দার আড়ালে যা ঘটে, তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলতেই পারে। সেসব কল্পনা ও জল্পনার কিছু সত্য হয় ফলে, আর কিছু কল্পনার ফানুস হয়ে মিলিয়ে যায়। বলেছি লন্ডন আলোচনায় প্রতিশ্রুত জাতীয় সরকার ও রিকনসিলিয়েশন-এই দুটি ইস্যু দুই নেতার আলোচনায় গুরুত্ব পেয়ে থাকতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফার ১ নম্বর দফাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ইশতেহার প্রকাশ করে। ইশতেহারের প্রথম দফায় বলা হয়, “প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক ‘Rainbow-Nation’ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এজন্য অব্যাহত আলোচনা, মতবিনিময় ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তিতে (Social Contract) পৌঁছাতে হবে। এ জন্য একটি ‘National Reconciliation Commission’ গঠন করা হবে।”
এখানে জাতীয় সরকারের কথা বলা না হলেও সবাইকে নিয়ে কাজ করার অঙ্গীকার রয়েছে।
বিএনপির ৩১ দফায় নির্বাচিত হলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার কথা বলা না হলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর দলটির নেতারা একাধিকবার জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলেছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিজেও বহুবার এই পরিকল্পনার কথা বলেছেন। ৮ ডিসেম্বর এক ভার্চুয়াল বক্তৃতায় তারেক রহমান বলেন, ‘দেশকে যদি পুনর্গঠন করতে হয় বিএনপি একা পারবে না, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে। এজন্য আমরা জাতীয় সরকারের কথা বলেছি। আমরা আন্দোলনরত যে দলগুলো ছিলাম, একসঙ্গে আমরা আন্দোলন করেছি, আমরা চাই সব দলকে নিয়ে এমন একটি সরকার গঠন করতে, যেখানে সব মানুষ তাদের মতামত রাখতে পারবেন এবং সবাই মিলে কাজ করতে পারবেন।’ দেখা যাচ্ছে, নির্বাচিত হলে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন ও রিকনসিলিয়েশন তথা সমন্বয় সাধনে বিএনপি সংকল্পবদ্ধ।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় সরকারের দাবি তুললেও আওয়ামী লীগ কর্ণপাত করেনি। তবে রিকনসিলিয়েশনের চেষ্টা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকবাহিনীর দোসর শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের ৩৭ হাজার সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তাদের নামে মামলাও করা হয়েছিল। তখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগে আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়েছিল সাত শতাধিক। বাকিদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়েছিল। সমাজের স্বাভাবিক ধারায় মিশে যেতে তাদের কোনো বাধা ছিল না। পাকবাহিনীর সমর্থক হিসেবে কাজ করেছে; কেবল এই অপরাধে তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি। তারা ব্যবসাবাণিজ্য, রাজনীতি সবই করেছেন। অনেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গেও মিশে গিয়েছিলেন। সেটা ছিল অঘোষিত রিকনসিলিয়েশন। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আরও বড় দাগে রিকনসিলিয়েশনের উদ্যোগ নেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী অনেক ডাকসাইটে নেতাকে তাঁর সরকার ও দলের সঙ্গে যুক্ত করেন। রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত করেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান কার্যত আওয়ামী লীগকেও পুনর্বাসিত করেন। বহু মত ও বহু পথের একটি রেইনবো অর্থাৎ রংধনু সমাজ বিকাশের সম্ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তখনই। তবে তখনো রাজনীতিতে রেইনবো টার্মটি সেভাবে চালু হয়নি।
এই টার্মটি প্রথম ব্যবহার করেন আর্চ বিশপ ডেসমন্ড টুটু। পরে দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বহুবার টার্মটি ব্যবহার করেন। ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর বর্ণবাদপীড়িত দেশে উপহার দেন রেইনবো সোসাইটি। ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে বহু মত, বহু পথের মানুষের একটি রংধনু সমাজ বিনির্মাণের অঙ্গীকার করেন এবং তিনি তা করতেও পেরেছিলেন। ম্যান্ডেলা নির্বাচিত হওয়ার পর রিকনসিলিয়েশনের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন এবং গঠন করেন জাতীয় ঐক্যের সরকার। প্রতিদ্বন্দ্বী বিদায়ি শেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট ডি ক্লার্ককে তাঁর সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে জাতীয় ঐক্য ও সমন্বয়ের অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আমাদের দেশেও জাতীয় ঐক্য ও রিকনসিলিয়েশনে চেষ্টা করা হয়েছে এবং বারবারই তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সেøাগান দিয়ে জাতিকে নির্দয়ভাবে বিভক্ত করেছে, ভেঙে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে জাতীয় ঐক্যের পাটাতন। জঙ্গিবাদবিরোধী হটকারী নীতি গ্রহণ করে বিশ্ববলয়ে জঙ্গি-অধ্যুষিত জনপদ হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশের জন্য শেখ হাসিনাকে অপরিহার্য শাসক হিসেবে তুলে ধরার ধুরন্ধর চেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
আজকে নতুন পরিস্থিতিতে রিকনসিলিয়েশন ও জাতীয় সরকার-এই দুটো ইস্যু সামনে এলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ ঘোষণার চেষ্টা করে চলেছে। গঠিত হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে চাইছে। কিন্তু বাস্তবে দূরত্ব বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা, রাখাইন রাজ্যের জন্য করিডর সর্বোপরি ইলেকশনার টাইমলাইন প্রশ্নে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। বিএনপিসহ প্রায় অর্ধশত দল ডিসেম্বর বা তার আগেই ইলেকশন চাইছে। তা সত্ত্বেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঈদুল আজহা উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এপ্রিলের প্রথমার্ধে ইলেকশনের টাইমলাইন ঘোষণা করেছেন। জামায়াতে ইসলামী ও বেশির ভাগ ইসলামী দল এই ঘোষণা হৃষ্টচিত্তে কবুল করে নিয়েছে। এনসিপিও সন্তুষ্ট। ছাত্রদের এই দলটি অবশ্য জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণপরিষদ ও স্থানীয় সরকার ভোটের দাবি থেকে সরে আসেনি। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারও তারা চাইছে এই সময়সীমার মধ্যে। এই পরিস্থিতিতে বোধগম্য কারণেই বিএনপি হতাশ। এ রকম অবস্থায় লন্ডনে ইউনূস-তারেক ডায়ালগ হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর থেকে জানা যায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ডিসেম্বরে নির্বাচনের দাবি থেকে কিছুটা সরে আসতে পারেন। জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে ইলেকশনের সময় নির্ধারিত হলে দলটি হয়তো আপত্তি করবে না। পক্ষান্তরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও শর্তসাপেক্ষ ছাড় দিতে সম্মত হতে পারেন। বিএনপির প্রতিশ্রুত নির্বাচনোত্তর জাতীয় সরকারের রূপরেখা সম্পর্কে আলোচনা হতে পারে। সেই জাতীয় সরকারে অন্তর্বর্তী সরকার বা সরকারপ্রধানের অংশভাগ থাকতে পারে কি না, তা-ও আলোচনা হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভাবমূর্তি যাতে ভবিষ্যতেও কাজে লাগানো যায়, সে ব্যাপারে বিএনপিও ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি বিএনপির মনোভাব পূর্বাপর ইতিবাচক। জানা যায়, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও চান না যে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির বিরোধ তৈরি হোক। এমতাবস্থায় লন্ডন আলোচনা সর্বোতভাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সেটা হলে আশা করা যায়, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে একটি ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ইলেকশন অনুষ্ঠানের পথে কোনো বাধা থাকবে না। হালফিল রাজনীতির চালচিত্রও বদলে যাবে। এটাই হবে রাজনীর নিউ ডাইমেনশন। দলগুলো নির্বাচনমুখী অবস্থান গ্রহণ করবে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকটও আর সেভাবে থাকবে না। সুগম হবে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথ।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক