ঐক্য একটি জাতির প্রধান শক্তি। মহান আল্লাহ আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিচ্ছিন্ন হতে নিষেধ করেছেন। এ বিষয়ে কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে-তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভক্ত হইও না। আর তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর নিয়ামতকে স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে-তারপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরে ভালোবাসার সঞ্চার করেছেন। অতঃপর তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা ছিলে আগুনের গর্তের কিনারায়, অতঃপর তিনি তোমাদের তা থেকে রক্ষা করেছেন। (আলে ইমরান ১০৩)।
বিশ্বের কাছে ঐক্যের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্তের নাম হজরত মুহাম্মদ (সা.)। অন্য মনীষীগণ বিভিন্ন বিষয়ে থিওরি দিয়েছেন, কিন্তু থিওরিকে বাস্তবে প্রয়োগ করে দেখাননি। ব্যতিক্রম রসুল (সা.)। তিনি উপদেশ দিয়েছেন, সমাজের বুকে সেই উপদেশের বাস্তবিক প্রয়োগ ঘটিয়ে দেখিয়েছেন।
রসুল (সা.) যে সময়ে পৃথিবীতে আসেন, সে সময়ের মক্কা-মদিনা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত জনপদ। মক্কার গোত্রীয় দাঙ্গা, মদিনার আওস-খাজরাজের যুদ্ধ ইতিহাসের পাতায় বড় বেদনাবিধুর অধ্যায় হিসেবে পঠিত হয়। ঐক্যের ডাক দিয়ে সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত, রক্তস্নাত জনপদকে রসুল (সা.) সোনার শহরে পরিণত করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মহান আল্লাহ উপর্যুক্ত আয়াত নাজিল করেছেন।
রসুল (সা.)-এর নেতৃত্ব ও ভালোবাসার জাদুতে সাহাবিরা এমন আপন হয়ে উঠেছিলেন, কিছুদিন আগে যারা ছিল পরস্পরের জীবনের শত্রু, সেই তারা অপর ভাইয়ের জন্য নিজের সমুদয় সম্পদ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হয়ে গেছেন। যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হতে চলেছেন অথচ নিজের বরাদ্দের পানিটুকু অপর আহত ভাইয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে রসুল (সা.)-এর বলিষ্ঠ নেতৃত্বগুণের ফলে। ভালোবাসা ও ঐক্যের এর চেয়ে উজ্জ্বল নমুনা আর কোথায় পাবেন!
হিজরতের পর মদিনায় চার শ্রেণির মানুষের বসবাস শুরু হয়। মক্কা থেকে আসা মুহাজির, মদিনার আনসার, ইহুদি এবং মদিনার আশপাশের বেদুইন সম্প্রদায়। নতুন গড়ে ওঠা একটি রাষ্ট্রে ভিন্ন ভিন্ন চার শ্রেণির মানুষের মাঝে তীব্র বিরোধ ও মতানৈক্য সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আদতে তা হয়নি। বরং মদিনা সনদ প্রণয়নের মাধ্যমে রসুল (সা.) ঐক্যের যে শক্ত প্রাচীর তৈরি করেছিলেন, মানবেতিহাসে যার কোনো তুলনা পাওয়া যায় না।
ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে ভেবে রসুল (সা.) অনেক জরুরি কাজও পরিত্যাগ করেছেন। কাবাঘর পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে কোরাইশরা ইবরাহিম (আ.)-এর ভিত্তির একাংশ বাদ দিয়েছিল। শেষ বয়সে এসে রসুল (সা.) পুরো ভিত্তির ওপর কাবা সংস্কার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নতুন মুসলমানরা ভুল বুঝতে পারে ভেবে তিনি সংস্কারের কাজে হাত দেননি। আবার বিশ্বাসঘাতক মুনাফিকদের বিরুদ্ধেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। কারণ এতে বহির্বিশ্ব ভাববে, মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। এতেও বোঝা যায়, রসুল (সা.) ঐক্যকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। ঐক্যের নির্দেশনা দিয়ে আল্লাহ অন্য আয়াতে বলেছেন, আর তোমরা আল্লাহ ও তার রসুলের আনুগত্য কর এবং পরস্পর ঝগড়া করিও না, তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর তোমরা ধৈর্য ধর, নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। (আনফাল)।
এ আয়াতেও আল্লাহ ঝগড়াবিবাদ না করে ঐক্যবদ্ধ থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আর ঝগড়াবিবাদ পরিহার করে সব মতের মানুষের সঙ্গে একত্র থাকা অনেক কঠিন কাজ। একসঙ্গে থাকতে গিয়ে নিজের মতের বিরোধী এমন অনেক বিষয় সামনে আসে, যা মেনে নেওয়া কঠিন। তারপরও দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে চুপ থাকতে হয়। নয়তো ঐক্যের দেয়ালে ফাটল ধরা অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর এ চুপ থাকার জন্য প্রয়োজন হয় পাহাড়ের মতো ধৈর্যের। এ জন্য আয়াতের শেষে ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে। উক্ত আয়াতের নির্দেশনা পরিবার থেকে রাষ্ট্র-সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটি পরিবার যদি সুসংহত ও শক্তিশালী অবস্থান অর্জন করতে চায়, তবে পরিবারের সদস্যদের মাঝে, ভিন্ন মত থাকা সত্ত্বেও, যূথবদ্ধ থাকতে হবে। পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধার চর্চা থাকতে হবে। তাহলে অন্য কেউ তাদের দুর্বল করতে পারবে না।
ঠিক একইভাবে একটি সমাজ তখনই উন্নত, সুসংহত ও শক্তিশালী হবে, যখন সমাজের মানুষেরা মতের অমিল সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সমাজের স্বার্থে সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবে। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টি সত্য। রাষ্ট্রে অনেক মতের, অনেক আদর্শের, অনেক ধর্মের মানুষ বসবাস করে। অনেক বিষয়ে তাদের মতানৈক্য থাকে। থাকাটাই স্বাভাবিক। তারপরও ভিন্নমতের মানুষগুলো পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধশীল থেকে রাষ্ট্রের বৃহৎ স্বার্থে যদি একসঙ্গে পথ চলে, তবে সেই রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা কেউ রোধ করতে পারে না। রসুল (সা.) বলেছেন, হে লোকেরা, ঐক্যবদ্ধ থাকা তোমাদের জন্য আবশ্যক এবং তোমরা বিচ্ছিন্ন হইও না। (তিরমিজি)।
গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ