আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে গোটা মুসলিম বিশ্বে পালিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহা ইসলাম ধর্মের অন্যতম নিদর্শন। মুসলমানদের দুটি মহা উৎসবের একটি। এই দিনটি ত্যাগ ও বিসর্জনের দিন। আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম দিন। এদিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শ্রেণি-পেশা-বয়সনির্বিশেষে ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য ঈদগাহ ও মসজিদে সমবেত হন। এদিন সামর্থ্যবানরা মহান প্রভুর সন্তুষ্টি লাভের আশায় পশু কোরবানি করেন। এর মাধ্যমে মানুষ তার হৃদয়ের গহিনে থাকা আল্লাহর প্রতি অসীম ভালোবাসার প্রমাণ পেশ করে থাকে। কোরবানি কার কবুল হয়েছে এবং কার কবুল হয়নি তা একমাত্র আল্লাহতায়ালাই জানেন। তবে ভাবনার বিষয় হলো, মহান প্রভু ঘোষণা করেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদের পক্ষ থেকে কবুল করেন, যারা আল্লাহকে ভয় করে।’ (সুরা মায়িদাহ-২৭)। কোরবানির মূল শিক্ষা হলো তাকওয়া অর্জন এবং ধর্মভীরু হওয়ার লক্ষ্যে ত্যাগ ও বিসর্জন। কার অন্তরে এই তাকওয়া স্থান পেয়েছে এবং কার মধ্যে তা নেই, বাহ্যিক অবস্থা থেকে তা বোঝার কোনো উপায় নেই। এটা যার যার অন্তরের ব্যাপার। কার অন্তর কতটা স্বচ্ছ ও নির্মলতা আল্লাহর কাছে পরীক্ষা হয়ে যাবে কোরবানির মাধ্যমে। কোরবানির ঈদ প্রতি বছর আসে আর যায়। কিন্তু আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে এর ফলাফল কী? আমাদের আচার-আচরণ ও ইবাদতে কী পরিমাণ তাকওয়া অর্জন হয়েছে, তা হিসাব করার প্রয়োজন আছে। আমরা জীবনে বহুবার পশু কোরবানি করেছি। আমার কোরবানি কবুল হয়েছে কী? কেন হয়নি তা কি ভেবে দেখেছি? পশু বিসর্জন দিয়েছি, বিসর্জন দিয়েছি মালসম্পদ। তাকওয়াপরিপন্থি আচার-আচরণ বিসর্জন দিয়েছি কী পরিমাণ। কী পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করেছি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত-বন্দেগিতে। তা-ও হিসাব করার প্রয়োজন। এখানে আমাদের মনে রাখতে হবে, পশু কোরবানির পাশাপাশি এর শিক্ষণীয় দিকগুলো জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকতে হবে। হতে হবে সর্বাবস্থায় একনিষ্ঠ ও খোদাভীরু। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে কখনো পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।’ (সুরা হজ-৩৭)। কোরবানি আমাদের ত্যাগ, বিসর্জন, উৎসর্গ এবং নিষ্ঠা ও এখলাস শিক্ষা দেয়। তাই আমাদের ইসলামের যাবতীয় বিধান পালনের ক্ষেত্রে এভাবেই নিবেদিত থাকতে হবে। ইসলামের যাবতীয় বিধান ব্যক্তিজীবনে এবং সামাজিক অঙ্গনে যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে, বিসর্জন দিতে হবে। এখলাসের মাধ্যমে যাবতীয় আমল একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করতে হবে। শিরকমুক্ত করতে হবে সব আমল, আকিদা ও যাবতীয় ইবাদত। ঈদের মাঠে ধনী-গরিবনির্বিশেষে সমবেত হওয়ার মাধ্যমে কোরবানি আমাদের সাম্য ও আদর্শ সামাজিকতার উপদেশ প্রদান করে। পরস্পর সর্বস্তরের মানুষ মিলেমিশে সৌভ্রাতৃত্বের আনন্দ উপভোগ করার অনুপ্রেরণা জাগ্রত করে। মুসলিম হিসেবে সবাই ভাই ভাই, হিংসা-বিদ্বেষ, ভেদাভেদ ভুলে যাই। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ অবস্থান গড়ে তোলার দীপ্ত শপথ নিই। এটাই হলো ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা, কোরবানির মহান ঐতিহ্য। আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, ‘বলুন, নিশ্চয় আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু শুধু বিশ্বজগতের প্রতিপালক মহান রাব্বুল আলামিনের জন্যই।’ (সুরা আনয়াম-১৬২)। একজন মুসলমানের জীবন কেমন হবে এর পূর্ণাঙ্গ চিত্র। উপরোল্লিখিত আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। একজন মুসলমান তার জীবনের প্রতিটি সময় শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সবকিছুই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত হবে। যা তাকে পার্থিব জীবনের মোহ থেকে মুক্ত করে একমাত্র আল্লাহর দিকে ধাবিত করবে। উপরিউক্ত আয়াতে মুসলিম জীবনে মূল্যবান চারটি আমল উল্লেখ করা হয়েছে।
১. আমার নামাজ : নামাজ মুসলমানদের সব ইবাদতের প্রাণ। তা আল্লাহর জন্য হবে বলে, যাবতীয় ইবাদত আমরা আল্লাহর জন্য হতে হবে এর স্বীকৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।
২. আমার কোরবানি (নুুসুক) : এর দ্বারা শুধু পশু কোরবানি বোঝানো হয়নি। বরং জান, মাল, সময় ও সব ধরনের আত্মত্যাগ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য স্বীকার করা বোঝানো হয়েছে।
৩. আমার জীবন : এর অর্থ হলো, আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কাজ, প্রতিটি সিদ্ধান্ত আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী হবে এর স্বীকৃতি।
৪. আমার মৃত্যু : এর অর্থ আমাদের মৃত্যুকেও আল্লাহর কাছে ন্যস্ত করার স্বীকৃতি প্রদান করা। এমনভাবে জীবনযাপন করব যেন মৃত্যু হবে আমাদের জন্য আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যম। মোট কথা, উল্লিখিত আয়াতে আল্লাহতায়ালা আমাদের সবকিছু আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার লক্ষ্যে তাঁর নবীকে নির্দেশ করেন, বলুন! ‘এই সবই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।’ অতএব, আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদের জীবনের সবকিছু একমাত্র আল্লাহর জন্য নিবেদিত করতে হবে। তাহলে আমাদের কোরবানির আসল সফলতা অর্জন হবে।
লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বসুন্ধরা, ঢাকা