শিরোনাম
বুধবার, ২৭ নভেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ

আজিম উদ্দিন আহমেদ

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ

মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন আমাদের অন্যতম জাতীয় নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও নেতা ছিলেন তিনি। দীর্ঘ এক দশক আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন মাওলানা তর্কবাগীশ। আজীবন সংগ্রামী এই নেতা বঙ্গবন্ধুকে সম্মান করতেন জাতির পিতা হিসেবে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যখন বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠিত হয় তখন এ সংগঠনের সভাপতিমণ্ডলীর একটি পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয় এই প্রবীণ নেতাকে। তিনি তাতে সম্মতি জানান এবং বলেন, ‘কলকাতায় শেখ মুজিব ছিলেন আমার পুত্রবৎ। স্বাধীন বাংলাদেশের তিনি স্থপতি, জাতির জনক। অতএব এবার তিনি আমারও জনক, আমারও পিতা। তিনি আজ নিহত। কিন্তু একদিন আসবে যেদিন মৃত মুজিব প্রমাণিত হবেন জীবিত মুজিবের চাইতেও শক্তিমান। সেদিন অবধারিতভাবেই আসছে।’ (মাওলানা তর্কবাগীশ : খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস)। জাতীয় নেতা তর্কবাগীশ জন্মগ্রহণ করেন ২৭ নভেম্বর, ১৯০০ সালে (১১ অগ্রহায়ণ, ১৩০৭) সিরাজগঞ্জের রশীদাবাদের তাকুটিয়ায়। তার পিতা হজরত আবু ইসহাক (রহ.) ছিলেন সুখ্যাত এক আধ্যাত্মিক পরিবারের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী এবং তার মাতা ছিলেন পুণ্যবতী বেগম আজিজুন নেছা। তার পূর্বপুরুষ হজরত শাহ সৈয়দ দরবেশ মাহমুদ (রহ.) ছিলেন বড়পীর হজরত শাহ সৈয়দ মহিউদ্দীন আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর উত্তরপুরুষ। হজরত সৈয়দ দরবেশ মাহমুদ (রহ.) ১৩০৩ সালে বাগদাদ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য ভারতবর্ষে আগমন করেন। মাওলানা তর্কবাগীশ বালক বয়সেই জমিদার-মহাজনদের শোষণ-নির্যাতন ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন।

১৯১৯ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনকালে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ছিলেন এন্ট্রান্স বা আজকের এসএসসি পরীক্ষার্থী। মেধাবী ছাত্র হয়েও তিনি স্কুল ত্যাগ করেন ব্রিটিশের গোলামি বানানোর শিক্ষা বর্জনের ডাকে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ১৯২২ সালে উপমহাদেশে স্বাধীনতা-সংগ্রামের রক্তাক্ত অধ্যায় ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা বিদ্রোহে’ নেতৃত্ব দেন সেদিনের তরুণ বিপ্লবী আবদুর রশীদ। তার নেতৃত্বে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সেদিন সলঙ্গা হাটে প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশি নির্যাতনে মারাত্মক আহত হয়ে তিনি কারাবরণ করেন। পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে সেদিন সলঙ্গা হাটে সরকারি হিসাবেই সাড়ে ৪ হাজার মানুষ হতাহত হন। ব্রিটিশ আমলে বাংলাদেশে ব্রিটিশবিরোধী সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। ১৯২৩ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হন তিনি। পরে উত্তরপ্রদেশের রায়বেরেলির বিখ্যাত দারুল উলুম মাদ্রাসায় আরবি শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন। বাঙালি ছাত্রদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে তিনি সেই মাদ্রাসা ত্যাগ করে সাহারানপুর মাদ্রাসায় গিয়ে ভর্তি হন। পরে সুবিখ্যাত দেওবন্দ মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। পরে লাহোরের বিখ্যাত ইশায়াতুল ইসলাম কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি ভূষিত হন ‘তর্কবাগীশ’ উপাধিতে। এ সময় মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে রচিত অশ্লীল গ্রন্থ ‘রঙ্গিলা রসুল’ ও আডিয়া (আর্য) সমাজের শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগঠিত করে এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে ওঠে। ভারতব্যাপী এই আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার রঙ্গিলা রসুল বাজেয়াপ্ত করে। বাংলার গরিব কৃষকসমাজকে জমিদারি-মহাজনী শোষণ-নিপীড়ন থেকে রক্ষার জন্য তার আন্তরিক কর্মপ্রচেষ্টার ফল ‘নিখিল বঙ্গ রায়ত খাতক সমিতি’। সর্জজনশ্রদ্ধেয় জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এই সমিতির সভাপতি এবং মাওলানা তর্কবাগীশ ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। দেশব্যাপী এই সমিতির ব্যাপক ও বলিষ্ঠ আন্দোলনের ফলেই গঠিত হয় ঐতিহাসিক ‘ঋণ সালিশি বোর্ড’। বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন মাওলানা তর্কবাগীশের অবদান; যা সফল হয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদের প্রথম সভাপতি হিসেবে মাওলানা তর্কবাগীশ সর্বপ্রথম বাংলায় যে সংসদীয় কার্যপ্রণালি প্রবর্তন করেন তা আজও চালু আছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা পুনরায় চালু করে মাওলানা তর্কবাগীশের পরামর্শে। শুধু তাই নয়, মাদ্রাসা শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে তিনি রাখেন নজিরবিহীন ভূমিকা। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবোচিত রূপে গড়ে তোলেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনেরও প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেন মাওলানা আবদুর রশীদ। ইসলামের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান যে সেবাদান করেছে ও করছে তারও গোড়াপত্তন করেন মাওলানা তর্কবাগীশ। রেডিওর বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে আরবি অনুষ্ঠান প্রচারও শুরু হয় তারই উদ্যোগে। এ ছাড়া রেডিও ও টেলিভিশনে কোরআন তিলাওয়াতের নিয়মও চালু করান তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বঙ্গবন্ধু পরিষদ গঠন এবং সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র কায়েমের সংগ্রামে তিনি যথাক্রমে ১০ ও ১৫ দল সংগঠনে ভূমিকা রাখেন।

জাতীয় নেতা আজীবন সংগ্রামী মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ১৯৮৬ সালের ২৩ আগস্ট ৮৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। সন্তানসম বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়েও যে শক্তিশালী স্থান করে নিয়েছেন জনমনে তাতে কোনো দ্বিমতের অবকাশ নেই।  মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা।

                লেখক : কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর