শিরোনাম
শনিবার, ১৪ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আগস্ট আতঙ্ক

সৈয়দ বোরহান কবীর

আগস্ট আতঙ্ক

আগামীকাল ১৫ আগস্ট। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ, দুর্ভাগ্যের দিন। আগস্ট এলেই এক শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়। অজানা শঙ্কায় বুক কাঁপে। এবার আগস্টে বেশি করে যেন শঙ্কার কালো মেঘ। কান পাতলেই ষড়যন্ত্রের কথা শোনা যায়। আওয়ামী লীগ শুধু নয় বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়, এখনো ষড়যন্ত্র চলছে। অনেকে খোলামেলাভাবেই বলেন, আরেকটি আগস্ট ট্র্যাজেডির ষড়যন্ত্র চলছে। কদিন আগে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বললেন, ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের কুশীলবরা এখনো সক্রিয়।’ আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘উত্তরণ’ আয়োজিত এক ওয়েবিনারে তিনি এ কথা বলেন। ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের বিচার হয়েছে, কিন্তু ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন হয়নি। আগস্ট ট্র্যাজেডি নিয়ে কোনো কমিশন গঠিত হয়নি। কয়েক বছর ধরে আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন মহল থেকে আগস্ট ষড়যন্ত্রে কার কী ভূমিকা তা খুঁজে বের করার দাবি উঠেছে। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও গত বছর জাতীয় শোক দিবসের আলোচনায় এবং এবারে শোকের মাসের প্রথম দিনে কৃষক লীগের অনুষ্ঠানে আগস্ট ট্র্যাজেডির ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করার কথা বলেছেন। আগস্ট ষড়যন্ত্রের আনুষ্ঠানিক কমিশন না হলেও এ সময় বিভিন্ন ক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ভূমিকা নিয়ে এখন খোলামেলা কথাবার্তা হয়। সবচেয়ে বেশি কথাবার্তা হয় আওয়ামী লীগের ভূমিকা নিয়ে। জাতির পিতার হত্যাকান্ডের পর আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় দল নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে থাকল কীভাবে? এ প্রশ্নটি এখন বড় করে সামনে আসে। আওয়ামী লীগ সভাপতিও এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এত বড় দল, এত নেতা, তারা কোথায় ছিল।’ আগস্ট ষড়যন্ত্র বিশ্লেষণ করলে চারটি বিষয় বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ সংগঠন হিসেবে বিভক্তি এবং আত্মতৃপ্তিতে ডুবে ছিল। দ্বিতীয়ত, ত্যাগী পরীক্ষিতদের দূরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়ত, চাটুকাররা বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে ফেলেছিল। চতুর্থত, অসত্য, মিথ্যাচার এবং নানা ঘটনা ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা সৃষ্টির এক পরিকল্পনার নীরব বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। আর এ চার কারণেই ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের পরও প্রতিবাদ হয়নি। ১৯৭৪ সালেই তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগে কোন্দল ও মতানৈক্য প্রবল এবং প্রকাশ্য ছিল। অনেক ক্ষেত্রেই দলের চেন অব কমান্ড নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কদিন আগে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক আমাকে একটি ছবি পাঠিয়েছিলেন। ছবিটি কথা বলছে যেন। ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু। জাতীয় চার নেতা অনেক দূরে। খুনি মোশতাক যেন জোর করেই বঙ্গবন্ধুর অনেক কাছে। মোশতাকরা যখন কাছে আসে তখনই বিপদ বাড়ে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বীজ বপন করা হয়েছিল। খুনি মোশতাকচক্র মুক্তিযুদ্ধ থামিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিল। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানের দৃঢ় ভূমিকার কারণে মোশতাক সফল হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র-তরুণরাও নানা কারণে তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। মুজিববাহিনীর সঙ্গে মুজিবনগর সরকারের দ্ধন্ধ ছিল প্রকাশ্য। স্বাধীনতার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরেন। জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই খুনি মোশতাক তাজউদ্দীন আহমদকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে বিষিয়ে তোলাই ছিল তার প্রধান এবং একমাত্র কাজ। মুজিববাহিনীর চার খলিফাও তাজউদ্দীনের ওপর খুশি ছিলেন না। ফলে মোশতাকের জন্য কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। শুধু তাজউদ্দীন আহমদ নন, আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মীদের দূরে ঠেলে দিয়ে খুনি মোশতাক এক বলয় তৈরি করেছিল। চাটুকাররা চারপাশে তাকে ঘিরে ফেলেছিল। এমনকি বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এ রকম বার্তা দেওয়ার পরও বঙ্গবন্ধু পাত্তা দেননি। এ দেশের মানুষ তাঁকে হত্যা করতে পারে, তিনি তা বিশ্বাস করতে পারেননি। এ সময় একের পর এক দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হয়। ’৭৪-এর কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ, বাসন্তীর সাজানো নাটক ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। এ সময় পাটের গুদামে আগুন, তথাকথিত ব্যাংক ডাকাতির কল্পকাহিনি, গুপ্তহত্যা, দুর্নীতির নানা মিথ্যাচার জনগণের মধ্যে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। জনগণের মধ্যে অস্বস্তি, হতাশা এবং সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা তৈরির নীলনকশা সফল হয়। চাটুকাররা ঘিরে থাকার ফলে বঙ্গবন্ধু অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত পরিস্থিতি জানতে এবং বুঝতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত, বাকশালের মাধ্যমে একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের সূচনা করলেন, ঠিক তখনই আঘাত হলো। বাকশাল প্রক্রিয়া সচল হলে ১৫ আগস্টের ঘটনার রাজনৈতিক প্রতিরোধ হতো বলেই আমি বিশ্বাস করি। ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকান্ডের পর আমরা কী দেখলাম। বঙ্গবন্ধুর শেষ মন্ত্রিসভায় তিনি ছিলেন রাষ্ট্রপতি। উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার মোট সদস্য ছিলেন ৩০ জন। এর মধ্যে ২৩ জনই বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর দিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় শপথ নিলেন। উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী এম মনসুর আলী, মন্ত্রিসভার সদস্য এ এইচ এম কামারুজ্জামান, আবদুস সামাদ আজাদ, এম কোরবান আলী এবং ড. কামাল হোসেন মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেননি। এর মধ্যে অবশ্য ড. কামাল বিদেশে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার এক সুবর্ণ সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। কিন্তু এক রহস্যময় নীরবতার চাদরে তিনি নিজেকে ঢেকে ফেলেছিলেন। এটা কি ষড়যন্ত্রের অংশ না কাপুরুষতা তা নিশ্চয়ই ইতিহাস একদিন বিচার করবে। বাস্তবতা হলো, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা যখন সুড়সুড় করে বঙ্গভবনে গিয়ে মোশতাকের আনুগত্য গ্রহণ করেছিল তখন আওয়ামী লীগের তৃণমূলে এবং জনগণের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ না হওয়ার এটি একটি বড় কারণ। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা মির্জা আজম। ছয়বারের এমপি। এখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ’৭৫-এ ছিলেন স্কুলছাত্র। তখনো রাজনীতিতে জড়াননি। এক আলাপচারিতায় বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীরা সব শপথ নিল। অনেকেই মনে করল আওয়ামী লীগই বোধহয় ক্ষমতায়। এখন বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হবে।’ এ রকম বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন অনেকে। ষড়যন্ত্র কত গভীর ছিল যে প্রায় গোটা মন্ত্রিসভাই ছিল বিশ্বাসঘাতকে পরিপূর্ণ। আওয়ামী লীগ যে ’৭৫-এর পর প্রতিবাদ করতে পারেনি তার অন্যতম কারণ ছিল এটি। শুধু মন্ত্রিসভা কেন? প্রায় পুরো আমলাতন্ত্র খুনি মোশতাকের আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। মোশতাকের শপথবাক্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদ সচিব। বঙ্গবন্ধু শেষ অনুষ্ঠান করেছিলেন ১৪ আগস্ট সন্ধ্যায়, গণভবনে। তাঁর একান্ত সচিব ফরাসউদ্দিনের বিদায় অনুষ্ঠান। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে তিনি বিদায় নেন একান্ত সচিবের দায়িত্ব থেকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর এ আমলার গায়ে এতটুকু আঁচড় লাগেনি। তিনি খুনি মোশতাকের অনাপত্তি নিয়েই বিমানে ওঠেন। একমাত্র ব্রিগেডিয়ার জামিল (বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব) ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত স্টাফদের সবাই কাপুরুষ অথবা বিশ্বাসঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কেন? কারণ তাদের আদর্শিক চেতনা ছিল না। চাটুকারিতাই ছিল একমাত্র দক্ষতা। ব্রিগেডিয়ার জামিল জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ব্যক্তিগত স্টাফদের কী করা উচিত ছিল। তিন বাহিনীর সে সময়কার প্রধানদের নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। এ নিয়ে আমি নতুন করে বলতে চাই না। শুধু মনে হয়, বিবেকশূন্য ক্লাউন না হলে এভাবে খুনিদের আনুগত্য স্বীকার অসম্ভব।

এ কথাগুলো উল্লেখ করলাম ১৫ আগস্ট হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের গভীরতা উপলব্ধির জন্য। এখন যদি আমি ৪৬ বছর পর বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকাই তাহলে কি কিছু মিল খুঁজে পাই? এখনকার মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্যের রাজনৈতিক ইতিহাস একটু ঘেঁটে দেখুন। এর বেশির ভাগই কোনো সংকটে ছিল না। আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের সামনের সারি তো নয়ই কোথাও দেখা যায়নি। মন্ত্রী হওয়ার আগে এদের অনেককে জনগণ তো দূরের কথা আওয়ামী লীগের কর্মীরাও চিনতেন না। এদের প্রধান কাজ চাটুকারিতা এবং লাগামহীন কথাবার্তা বলে সরকারকে বিব্রত করা। পৈতৃকসূত্রে এদের কেউ জাতীয় পার্টি, কেউ ব্যবসায়ী। কোনো সংকটে এরা কি সাহসে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারবে? এদের মধ্যেই কি মোশতাকের অবয়ব পাওয়া যায়?

এখন সরকারে আমলাদের বাড়বাড়ন্ত। এ আমলারাই যেন আওয়ামী লীগ এবং সরকারকে উদ্ধার করবে। এদের অনেকে যেভাবে বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনার নাম জপেন তাতে এরা নিজেদের নামই ভুলে গেছেন কি না সন্দেহ হয়। কিন্তু ইতিহাস বলে, সব সংকটে বেশির ভাগ আমলা হয় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, নয় তো কাপুরুষের মতো গুটিয়ে গেছে। রফিকুল্লাহ চৌধুরী, আলাউদ্দিন নাছিম কিংবা ওবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর মতো কজন আমলা আদর্শের জন্য নিজেদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়েছেন? এবার ষড়যন্ত্র এবং মিথ্যাচারের ঘটনাগুলো মিলিয়ে দেখা যাক। ৪৬ বছর পর সেই একই ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার যেন আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ’৭৪-৭৫-এ আগুন লাগত পাটের গুদামে। এখন আগুন লাগে ফ্যাক্টরিতে। পদ্মা সেতুর পিলারে বারবার কেন ধাক্কা দেবে ফেরি কিংবা ট্রলার? এটা কি স্রেফ দুর্ঘটনা? দেশে যখন করোনার ভয়াবহ সংক্রমণ, তখন ঢাকঢোল পিটিয়ে পরীমণি, পিয়াসা, মৌ নাটকের আসল উদ্দেশ্য কী? এসব অভিযানের পর নানা ভিডিও ফুটেজ কারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে? এসব অভিযানে সরকারের কি ইমেজ বাড়ছে না কমছে? ইত্যাদি হাজারো প্রশ্ন সামনে আসছে। কিছুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সুইডেন থেকে লাগামহীন অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার বমি করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। কনক সরোয়ার, ইলিয়াস হোসেন, বরখাস্ত সেনা কর্মকর্তা শহীদ, তাজ হাশমীর মতো কিছু কুলাঙ্গার যেভাবে সরকার এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত নোংরা, কুৎসিত কথাবার্তা বলছে যা নজিরবিহীন। এরা গুজব ছড়িয়ে মানুষজনকে বিভ্রান্ত করছে। এদের একজন গত মঙ্গলবার পরীমণির এক ভিডিও ক্লিপ ছেড়েছে। পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে পরীমণির এ ভিডিও ক্লিপ সুদূর আমেরিকায় পাঠাল কারা? এরা যে রাষ্ট্রের গোপন এবং স্পর্শকাতর তথ্যও এভাবে পাচার করছে না, তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারবে? পরীমণির ঘটনার পর দেখলাম চরিত্রহননের এক বন্য উৎসব। বিকৃত সাংবাদিকতায় ক্ষতবিক্ষত হলেন অনেক ব্যবসায়ী, ব্যাংকের কর্মকর্তা। ব্ল্যাকমেলিংয়ের এক বিকৃত খেলা শুরু হলো। এ খেলা তো উসকে দেওয়া হলো ভিতর থেকেই। এখন গুজবে দেশ সয়লাব। যে যেভাবে পারছে গল্প বানাচ্ছে। কেচ্ছাকাহিনির সব তথ্য সন্ত্রাসের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে সরকারই। এ নাটকের নেপথ্যের উদ্দেশ্য নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে। একজন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অত্যন্ত মেধাবী। ‘আল থুসার’ এবং ‘আগস্ট আবছায়া’ নামে তার দুটি উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ, অভিভূত। ক্যাডেট কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে জেনে বুকটা গর্বে ভরে উঠেছিল। পরীমণি কেলেঙ্কারিতে তাকেও জড়িয়ে ফেলা হলো। ফেসবুকে তার বক্তব্য পড়ে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললাম। সাংবাদিকতা কি এত কুৎসিত হতে পারে! ঢাকার পুলিশ কমিশনার নিজেই এক সংবাদ সম্মেলনে জানালেন বহু ব্যবসায়ীকে ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে। আতঙ্কে তারা ফোন করছেন। জানতে চাইছেন বাসায় থাকব কি না। ব্যবসায়ীদের মধ্যে কি পরিকল্পিত ভীতি, আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে? তারা যেন ব্যবসাপাতি গুটিয়ে বিদেশে চলে যান। স্বাধীনতার পর দুটি গণমাধ্যম বঙ্গবন্ধু এবং স্বাধীন দেশের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচারে নেমেছিল। ‘হলিডে’ এবং ‘গণকণ্ঠ’। এখনো এ পুরনো পত্রিকাগুলো পড়লে গা শিউরে ওঠে। কী ভয়াবহ। এখনো একই মালিকানায় দেশের প্রভাবশালী দুটি পত্রিকা (একটি বাংলা একটি ইংরেজি) একই চরিত্রহননের খেলায় মেতেছে। এ দুটি পত্রিকা ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেভাবে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে লাগাতার অপপ্রচার করেছিল, এখন আবারও তা করছে। যে পত্রিকা দুটি আওয়ামী লীগ সভাপতি পড়েন না বলে জাতীয় সংসদে প্রকাশ্য ঘোষণা দেন, সেই পত্রিকার গোলটেবিল আর ওয়েবিনারে গিয়ে এ সরকারের অনেক মন্ত্রী ধন্য হন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক একজন সজ্জন মানুষ। আকণ্ঠ ডুবে থাকা স্বাস্থ্য খাতে তিনি নিজেকে দুর্নীতি এবং বিতর্ক থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছেন। কদিন আগে ওই প্রভাবশালী বাংলা পত্রিকার একজন রিপোর্টারের দুর্ব্যবহারের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। বললেন, ‘একজন সাংবাদিক কী করে এমন আচরণ করতে পারেন।’ প্রশ্নটা আমারও। এ দুটি পত্রিকা কীভাবে এত দম্ভ দেখায়? কারণ সরকারের ভিতরেই তাদের চর এবং চামচা দুটোই আছে। এ দুটি পত্রিকার সঙ্গে সরকারের যে মন্ত্রী, আমলাদের প্রকাশ্য এবং গোপন প্রণয়, তারাই একালের মোশতাক। এসব দেখে-শুনে, আরেকটি আগস্ট আতঙ্ক আমাকে পেয়ে বসে। ইতিহাসের সেই সত্য কথাটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করি। ‘ইতিহাসের সব থেকে বড় শিক্ষা ইতিহাস থেকে কেউ শেখে না’। কিন্তু এ আতঙ্ক-উদ্বেগের মধ্যেও আশার আলো জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন একজন মানুষ। তাঁর নাম শেখ হাসিনা। যখন হতাশায় মুষড়ে পড়ি তখন তাঁর হঠাৎ সিদ্ধান্ত যেন জাতিকে উৎসাহিত করে। শঙ্কার মেঘ কেটে যায়। মঙ্গলবার (১০ আগস্ট) অনুষ্ঠিত হলো একনেকের বৈঠক। কতিপয় চাটুকার আমলা জামালপুরে একটি সোলার পার্কের নাম ‘শেখ হাসিনা সোলার পার্ক’ রাখার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এ তৈলমর্দন প্রত্যাখ্যান করেন। এটি প্রথম না, এর আগেও শেখ হাসিনা অন্তত দুবার চাটুকারদের আশাহত করেছিলেন। এ ঘটনাটি আমার বিবেচনায় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখনো চাটুকাররা শেখ হাসিনাকে পুরোপুরি ঘিরে ফেলতে পারেনি। শেখ হাসিনা পাকা জহুরি। তিনি সবাইকে চেনেন। সবার আসল রূপটা জানেন। মাত্রা ছাড়া হলে তিনি ঠিকই ব্যবস্থা নেবেন। এমন আশাবাদটা প্রবল হয়। তখন কার্ল মার্কসের কথাটা সত্যি মনে হয়- ‘ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয় বটে তবে তা একইভাবে হয় না। প্রথমটা ট্র্যাজেডি, দ্বিতীয়টা হয় প্রহসন।’ তাই যারা আরেকটা আগস্ট ষড়যন্ত্রের স্বপ্ন দেখেন, নীলনকশা তৈরি করেন তারা হয়তো শেষ পর্যন্ত একটা কৌতুকই মঞ্চস্থ করতে পারবেন।

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

ইমেইল : [email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর