আমরা নতুন আরেকটি হিজরি সনে প্রবেশ করেছি। এই সনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নবীজি (সা.)-এর হিজরতের স্মৃতি। পৃথিবীতে বিভিন্ন রকম সন গণনার প্রচলন রয়েছে। হিজরি সন তার একটি। অন্যান্য সনের সঙ্গে হিজরি সনের একটি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেটা হলো, মানুষ দুঃখের ইতিহাস ভুলে থাকতে চায়, সুখের স্মৃতি বারবার স্মরণ করে আনন্দ পায়। খ্রিস্টানরা তাই ঈসা (আ.)-এর জন্মসাল থেকে খ্রিস্টীয় সন গণনা শুরু করেছে। কিন্তু সাহাবিগণ প্রথার বাইরে গিয়ে উল্টো কাজ করেছেন। তাঁরা হিজরতের মতো বেদনাদায়ক ঘটনা থেকে হিজরি সন গণনা আরম্ভ করেছেন। কারণ হিজরতের ত্যাগই মুসলিমদের উত্থানের পটভূমি তৈরি করেছে। এর মাধ্যমে আমরা আরেকটি জিনিস উপলব্ধি করতে পারি। মানুষের জীবনে ঘুরে দাঁড়ানোর বীজ বপিত থাকে দুঃখের ভিতর। দুঃখই মানুষকে পুড়িয়ে খাঁটি সোনা বানায়। তাই মেঘ দেখেই যেন আমরা ঘাবড়ে না যাই। কারণ মেঘের আড়ালে আছে সূর্যের হাসি।
বর্তমানে গোটা পৃথিবীতে যে সনটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, একে আমরা ইংরেজি সন বলি। আসলে এটা ইংরেজি সন নয়। এটা ঈসায়ী বা খ্রিস্টীয় সন। ঈসা (আ.)-এর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এই সনের উৎপত্তি। আবার হিজরি সনকে অনেকে আরবদের সন মনে করে। এটা আরবদের সন নয়। এটা মুসলমানদের সন। নবীজি (সা.)-এর হিজরতের দিন থেকে এই সনের গণনা শুরু। মূলত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে প্রশাসনিক কার্যক্রমের হিসাব সহজ করার জন্য সাহাবিদের পরামর্শে এই সনের প্রবর্তন করা হয়।
সাহাবিদের হিজরত সাধারণ কোনো সফর ছিল না। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে আত্মত্যাগের এক অনুপ্রেরণাদায়ক ইতিহাস। নানা কারণে আমাদেরও আবাসস্থল পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু সেই গমন স্থায়ী গমন নয়। চাইলেই আমরা পূর্বের আবাসভূমিতে ফিরে আসতে পারি। কিন্তু ইমান রক্ষার জন্য নবীজি (সা.) ও সাহাবিগণ যখন হিজরত করেন, বাহ্যত সেটা ছিল চিরকালের জন্য জন্মভূমি ছেড়ে যাওয়া। কোনো দিন যে তাঁরা আবার মক্কায় ফিরতে পারবেন, এমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। আবার বর্তমান কালের শরণার্থীদের সঙ্গে নবীজি (সা.)-এর হিজরতকে পুরোপুরি মেলানো যাবে না। কারণ শরণার্থীরা সঙ্গে করে অনেক কিছু নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু নবীজি (সা.) যখন হিজরত করেন, সঙ্গে কিছুই নিতে পারেননি। রাতের অন্ধকারে গোপনে তাঁকে গৃহত্যাগ করতে হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, হত্যা করার জন্য তাঁর বাড়ি ঘেরাও করা হয়েছিল। তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল। পথে পথে তাঁকে খোঁজা হয়েছিল। তাঁর পেছনে ধাওয়া করা হয়েছিল। অধিকাংশ সাহাবিকেও একই রকম জুলুম-নিপীড়নের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এই জুলুম-নিপীড়নের একমাত্র কারণ ছিল তাঁদের ইমান। আর তাই হিজরতকারীদের জন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে এক বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যাঁরা ইমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং নিজেদের ধনসম্পদ ও জান দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তাঁরা আল্লাহর কাছে উচ্চমর্যাদার অধিকারী। আর তাঁরাই হলো সফলকাম [তওবা ২০]।
হিজরত আপাতদৃষ্টিতে বেদনার ঘটনা হলেও পরবর্তী সময়ে এই হিজরতই হয়ে উঠেছিল মুসলমানদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রধান টার্নিং পয়েন্ট। যার স্বর্ণালি প্রতিফলন আমরা বদর-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মাঝে পরিস্ফুট হতে দেখি। শুধু তা-ই নয়, হিজরতের পর মুসলমানরা এমনভাবে ঘুরে দাঁড়ায়, মাত্র আট বছরের ব্যবধানে বিপুল বিক্রমে, বীরের বেশে, সেই উৎপাটিত মানুষগুলোই আবার জন্মভূমি মক্কা বিজয় করেন। ইমান রক্ষার জন্য শুধু নবীজি (সা.) ও সাহাবিগণই হিজরত করেননি, বরং যুগে যুগে সব নবী-রসুল হিজরত করেছেন। এমনকি আসহাবে কাহাফের যুবকরা, যাঁদের ইমানদীপ্ত সাহসের ঘটনা পবিত্র কোরআনে প্রত্যুজ্জ্বল হয়ে আছে, তাঁরাও ইমানের জন্য গুহায় আশ্রয় নিয়েছেন। ইউসুফ (আ.)-এর জেলখানায় অন্তরীণও এ ধরনের ইমান রক্ষার হিজরত। হিজরত শুধু একটি ঘটনা নয়। এটি একটি ঐশী চেতনার নাম। রসুল (সা.) বলেছেন, প্রকৃত মুহাজির (হিজরতকারী) তিনি, যিনি আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করেন (বোখারি)। অর্থাৎ শারীরিক হিজরত যেমন আছে, তেমনই আছে আত্মিক হিজরত। আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ ত্যাগ করাই হলো আত্মিক হিজরত। আর এই আত্মিক হিজরত সর্বজনীন, সর্বকালীন। শারীরিক হিজরতের অনিবার্যতা সবার জীবনে আসে না। কিন্তু আত্মিক হিজরত সবার জীবনেই চির প্রাসঙ্গিক। হিজরতের মূল শিক্ষাই হলো ত্যাগ। অথচ আমাদের জীবনের সবটা দখল করে আছে ভোগবাদী মানসিকতা। হিজরতের শিক্ষা থেকে আজ আমরা যোজন যোজন দূরে সরে এসেছি। ইমান রক্ষার জন্য নবী-রসুলগণ প্রতিকূল পরিবেশ ত্যাগ করে অনুকূল পরিবেশে হিজরত করেছিলেন। আর আমরা একটুখানি বৈষয়িক সাফল্যের আশায় ইমানের জন্য প্রতিকূল জীবন বেছে নিচ্ছি। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে!
জুমার মিম্বর থেকে গ্রন্থনা : সাব্বির জাদিদ