মঙ্গলবার, ১৭ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

আমার জীবনের সর্বনাশা ১৫ আগস্ট

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

আমার জীবনের সর্বনাশা ১৫ আগস্ট

লিখছি ১৫ আগস্ট রবিবার, ছাপা হবে ১৭ আগস্ট মঙ্গলবার। ২০/৩০ বাবর রোডের যে ঘরে বসে লিখছি ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট শুক্রবার সে ঘর থেকেই এক কাপড়ে বেরিয়ে ছিলাম। বৃহস্পতিবার রাত প্রায় ২টায় মোহাম্মদপুরের বাড়ি ফিরেছিলাম। কারণ ১৪ আগস্ট ১টা ৪০ মিনিটে পিতার সঙ্গে কথা বলে ধানমন্ডি থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। দেখতে দেখতে কত দিন হয়ে গেল। বাবর রোডের বাড়ি ফিরেছি ঠিকই, কিন্তু কোনো দিক থেকেই পিতার বর্তমানে সবল সন্তানের যে অবস্থান তার তিরোধানে এতিম সন্তান সেখানে আর ফিরতে পারেনি। সময় তো শেষ আর ফিরতে পারব তাই-বা বলি কী করে, আর তেমন আশাও করি না। যে কদিন বেঁচে আছি কাউকে না ঠকিয়ে সততার সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারলেই হলো।

আজ দেড় বছর ঘরে বসা। তাই শরীর অনেকটা নষ্ট হতে চলেছে। মাটিতে বসে নামাজ পড়তে পারি না সেও প্রায় তিন-চার মাস হয়ে গেল। ধীরে ধীরে আরও কত কী হবে তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই জানেন। করোনায় সাধারণ মানুষ সর্বস্বান্ত, দিশাহারা। গাড়ি-ঘোড়া বন্ধে মানুষ কী যে কষ্ট করেছে আর তাতে সরকার কতটা যে অপ্রিয় হয়েছে তা বোঝানোর শক্তি এখন অনেকের নেই। হয়তো যখন সময় হবে তখন বুঝেও কোনো কাজ হবে না। দেখুন কী মজার ব্যাপার! কঠোর লকডাউনে মৃত্যু সংখ্যা উঠেছিল ২৬৪। লকডাউন তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা প্রথমে ২১৫, তারপর ১৯৭। ১৫ আগস্ট পর্যন্ত ১৭৮। তাহলে তো লকডাউনের চেয়ে মুক্ত থাকাই ভালো। আসল কথা লকডাউন করোনার কোনো প্রতিকার নয়। করোনার প্রতিকার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, সর্বোপরি আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা। কতই তো উথাল-পাথাল হলো খোঁজ নিয়ে দেখুন বস্তির কজন আক্রান্ত হয়েছে, কজন শ্রমিক আক্রান্ত হয়েছে, গার্মেন্টে কে আক্রান্ত হয়েছে? কেউ না। পরিশ্রমী, রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা মানুষ করোনাকে জয় করেছে। যারা শুয়ে-বসে খায়, শরীরে মেদ জমেছে তাদের বেশিসংখ্যক করোনায় আক্রান্ত। সারা বিশ্বে করোনার টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে। বড় বড় কথা না বলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সবাইকে টিকা দেওয়া দরকার। এ কার্যক্রম যথাযথ করলে বিপদ অনেকটা কমে যাবে। তাই মহাপ-িতদের বেশি প-িতি না করতে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন।

দেশে এখন চলচ্চিত্রশিল্পী পরীমণিকে নিয়ে চরম আলোচনা। একজন নারী, একজন মহিলাকে নিয়ে প্রচারমাধ্যমের এতটা ঝাঁপিয়ে পড়া অনেকের কাছেই মনঃপূত নয়। হাজার হলেও পরীমণি একজন নারী। সবারই বাবা-মা আছে, ভাইবোন আছে, সন্তান-সন্ততি আছে। পরীমণিও তো তাদের একজন হতে পারত। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে মাদকের মামলায়। তাহলে কে তার বাড়ি গেল, কার বাড়ি সে গেল এগুলো তো মামলার বিষয় নয়। তার বাড়িতে মদ পাওয়া গেছে, মারাত্মক নেশাবস্তু পাওয়া গেছে। ভালো কথা। কিন্তু সেগুলো কি তার কাছ থেকে পাওয়া গেছে? তার বাড়িতে পাওয়া গেছে। বাড়িতে তো আরও লোক থাকে। আর যখন তাকে গ্রেফতার করা হয় বাইরের নিরপেক্ষ লোক নিয়ে কি তল্লাশি করা হয়েছে? নাকি যারা পরীমণিকে গ্রেফতার করেছে তারাই ওসব সাজিয়ে তাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন? পরীমণির কথা কি মিথ্যা, তার মামলায় পেছন থেকে কেউ কেউ কলকাঠি নাড়াচ্ছে। মাদক মামলার আসামিকে কি বেল দেওয়া হয়নি? পরীমণির কি কখনো জামিন হবে না? জামিনও হবে, মামলা থেকে খালাসও পাবে। কারণ মামলাটি দুর্বলভাবে সাজানো আর এমনিতেই মিথ্যার একটা দুর্বলতা থাকে। হত্যা মামলার আসামিরা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারে। তবে কেন পরীমণির শত বছরের নানা দেখা করতে পারলেন না?

যাক, এসব নিয়ে পরে কখনো লিখব। ১৫ আগস্ট আমার জীবনের সর্বস্ব হারানোর দিন। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যেভাবেই গিয়ে থাকুক ’৭৬-এর ১৫ আগস্ট ছিলাম প্রতিরোধযুদ্ধে মেঘালয়ের পাদদেশে চান্দভূই ক্যাম্পে। ১৫ আগস্ট সকালে যখন সহযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছিলাম দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি, বসে থাকতেও পারিনি। আমার চোখে অশ্রুর সাগর বইছিল। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী তখন চান্দভূই ক্যাম্পে ছিলেন। সন্তানের মতো ধরে রেখেছিলেন। অফিসঘরে বসে থাকতে না পারায় পাশেই সাধারণ যোদ্ধাদের মাটির বিছানায় শুইয়ে দিয়েছিলেন। নিচে ছিল ধান-চালের বস্তা কাটা চট, ওপরে একটা চাদর। তাতেই শুয়ে ছিলাম সারা দিন। এক ফোঁটা পানি পর্যন্ত পান করিনি। শরীরকে কষ্ট দিতাম। আত্মা তো কষ্ট পাচ্ছিল অহর্নিশ। ’৯০-এ দেশে ফিরে ১৫ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত দানাপানি গ্রহণ করতাম না, ঘরের দরজা খুলতাম না। ২০০০ সালের পর থেকে দানাপানি গ্রহণ করি, ঘুম থেকে উঠে দরজাও খুলি। আজকেও যেমন ফজরের নামাজ আদায় করে চোখের পানি ফেলে দরজা খুলে লিখতে বসেছি। এখন আর নিজে হাতে লিখতে পারি না। বছরখানেক যাবৎ হাত কাঁপে, শরীরও একটু একটু কাঁপে। অন্যের দ্বারা লেখা তৈরি করতে হয়। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী একবার কলম নিয়ে ৩০ পৃষ্ঠা লিখে গেলেও তাঁর কলম তুলতে হতো না। আমার আগাগোড়াই এক পৃষ্ঠা লিখতে তিনবার কলম তুলতে হতো। এখন লেখা তৈরি করে দু-তিন বার দেখি। তাই দুর্বলতা অনেক। গতকাল ছিল (১৪ আগস্ট) আমার স্ত্রী নাসরীন কোরায়েশীর মনে হয় ৬৮তম জন্মদিন। নাসরীন এখন সিদ্দিকী। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হবে, বিয়ের আগে কোনো দিন কল্পনাও করিনি। মেয়েটি খুব ভোলাভালা সাদামাটা। গতকাল তিনি তাঁর জন্মদিনও ভুলে গিয়েছিলেন। আমিই সকালে টাঙ্গাইল থেকে টেলিফোনে জন্মদিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছি। টাঙ্গাইল গিয়েছিলাম ৯ আগস্ট কঠোর লকডাউনের মধ্যে। আবার ১৪ আগস্ট টাঙ্গাইল থেকে ফিরেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠেছিলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে। এখন হয়তো অনেকেই জানেন না, ষাটের দশকে সিরাজউদ্দৌলার একটা প্লে সব সময় মাইক্রোফোনে বাজানো হতো। কোথাও সিরাজউদ্দৌলার প্লে শুনলেই দাঁড়িয়ে যেতাম, বসে যেতাম, শরীরের লোম খাড়া হয়ে যেত। সে রকম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একসময় ছিল আমাদের উদ্দীপনা, আমাদের জন্য প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার অথবা আকাশবাণী কিংবা বিবিসি থেকে যখন শুনতাম দেহমনে শিহরণ জাগত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সে ভাষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন সারা বিশ্বে কয়েকটি ভাষণের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি। তার একটা জাতীয় মর্যাদা থাকা উচিত। যত্রতত্র যেখানে সেখানে যেভাবে সেভাবে ভাষণটি বাজানো অবমাননাকর। অথচ প্রতিনিয়ত সে অবমাননাই করা হচ্ছে। টাঙ্গাইল জেলা তথ্য বিভাগ ওষুধের ক্যানভাসারের মতো বঙ্গবন্ধুর খন্ড খন্ড ভাষণ বাজায় আবার শোক দিবসের প্রচার করে। এ যেন কোনো সার্কাস! ১৪ আগস্ট টাঙ্গাইল থেকে ঢাকার পথে ১০-১২ জায়গায় ৭ মার্চের ভাষণ শুনেছি। কেন যেন বারবার মনে হয়েছে, হায়রে কপাল! তাঁর মরেও মুক্তি নেই। সভা-সমিতিতে লোক জড়ো করতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৫ আগস্ট শোকের দিনেও তাঁর ভাষণ। কবে যেন বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে এক অতি সাধারণ অসহায় বৃদ্ধ বলেছিলেন, ‘হায়রে হায়, মানুষটারে একটু পানি খাবারও দেয় না।’ কথাটা শুনে আমার কলিজার বোঁটা ছিঁড়ে গিয়েছিল। বলেছি, অনেকবার। কিন্তু কেউ শোনে না, কেউ উপলব্ধি করে না। কারণ বিচার-বিবেচনাবোধ কেমন যেন নষ্ট হতে চলেছে। সঠিক বিচারবোধ অনেকের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় না। ১৪ আগস্ট শনিবার সৈয়দ বোরহান কবীরের অসাধারণ চমৎকার এক লেখা পড়লাম। সেখানে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর্বে একমাত্র কর্নেল জামিলকে বাহবা দিয়েছেন, গাজী সালাউদ্দিনের চেয়ে বড় করে দেখিয়েছেন, ক্ষুদিরামের চেয়ে বড় বঙ্গবন্ধু-প্রেমিক হিসেবে তুলে ধরেছেন। আমিও মানি, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে অথবা সাধারণ নাই-বা হলো তিনি যদি বঙ্গবন্ধুকে বাঁচাতে এসে নিহত হতেন তাহলে তাকে মাথায় তুলে রাখতাম। কর্নেল জামিল ছিলেন ডিজিএফআইর প্রধান। ছিলেন রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তাপ্রধান, গোয়েন্দাপ্রধান। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার জন্য এক ব্রিগেড মানে ৩ হাজার সেনা তাকে আলাদাভাবে দেওয়া হয়েছিল। সেই সঙ্গে দুটি সামরিক হেলিকপ্টার যার একটি গণভবনে ছিল। ১৪ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুরান ঢাকায় বোমা ফাটানো হয়েছিল। পুরো প্রশাসন তোলপাড়, ট্যাংক রেজিমেন্টকে তিনটি ট্যাংক নিয়ে মহড়া দিতে বলা হয়েছিল। জাতির পিতার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া নিয়ে যখন সবাই বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছেন তখন নাকে সরিষার তেল দিয়ে কর্নেল জামিল ঘুমিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর টেলিফোনে তিনি ঘুম থেকে জেগে হাফশার্ট গায়ে ছুটে এসেছিলেন। কলাবাগানে বিপথগামীদের হাতে গুলি খেয়ে নিহত হন। তিনি হিরো বনে গেলেন! তিনি যখন ছুটে আসছিলেন তার স্ত্রী বলেছিলেন, ‘তুমি একা গিয়ে কী করবে? রিভলবারও তো নিলে না?’ গুলি খেয়ে মরে তিনি হিরো হয়ে গেলেন। কেউ জিজ্ঞাসা করল না বা করে না বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার ষোলোআনা দায়িত্ব ছিল কর্নেল জামিলের। তিনি তো একটা ব্যাটালিয়ান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েননি, ব্যাটালিয়ান থাক একটা কোম্পানি নিয়েও প্রতিরোধ করেননি, ১০ জন সেনা নিয়েও বাধা দিতে পারেননি। তিনি হলেন হিরো আর আমরা জীবন পাত করে হলাম জিরো। সৈয়দ বোরহান কবীরের মতো একজন চৌকশ সাংবাদিক আমার ছোট ভাই সন্তানের মতো প্রিয়। সে অনেক অসাধারণ লেখা লেখে। তার মাথায়ও এক মুহূর্তের জন্য এলো না যে কর্নেল জামিল যে-সে মানুষ ছিলেন না। তার ওপর নিরাপত্তার পুরো দায়িত্ব ছিল। আমার ওপর অমন দায়িত্ব থাকলে আর আমি ব্যর্থ হলে আমাকে কি কেউ ক্ষমা করত? শুধু বোরহান কবীরকে বলব কেন, আমার বোনেরাও ব্যাপারটি সেভাবে বিবেচনা করেন না। না হলে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ১৬ জনের মধ্যে কর্নেল জামিলের ছবি থাকে কী করে? গত ১৫-২০ বছর তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদকারী হিসেবে একবারও আমার নাম নেননি। কিন্তু কর্নেল জামিলের নাম নিয়েছেন অনেকবার। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভদ্রলোক পাকিস্তানে ছিলেন। যেদিন তাকে ব্রিগেডিয়ার পদে উন্নীত করা হয় সেদিন গণভবনে আমিও ছিলাম। পাকিস্তান-ফেরত বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তায় ব্যর্থ জামিল হয়ে গেলেন শহীদ। আর সর্বস্ব খুইয়ে আমি এবং আমরা হলাম রাজাকার। সবাই যখন বিহ্বল, মন্ত্রিসভায় সব বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী। অনেকে তো মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগের সরকারই প্রতিষ্ঠিত। তাই যা করার সরকারই করবে। ঘোর কাটতেই অনেকের সময় লেগে যায়। আমার এবং আমাদের তেমন লাগেনি। এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিলাম। প্রতিবাদ করেছিলাম, প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম। এখন কষ্ট হয় মোশতাক-জিয়া-এরশাদ এমনকি বেগম খালেদা জিয়ার আমলেও প্রতিরোধ যোদ্ধা জাতীয় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছিলেন রাষ্ট্রের কাছে দুষ্কৃতকারী। ১০৪ জন প্রতিরোধ যোদ্ধা শহীদ হয়েছেন। তাদের জন্য কম করে সাতবার সংসদে শোকপ্রস্তাব আনার চেষ্টা করেছি। সংসদ নেত্রীর অনুমতি ছাড়া আনতে পারিনি। অনেকেই অনেক কিছু বলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও প্রতিরোধ যোদ্ধারা দুষ্কৃতকারী এটা ইতিহাসের পাতায় থেকে গেলে নেত্রী শেখ হাসিনার ওপরও যে দায়ভার আসবে না তা নয়। ভাবীকাল অনেক কঠিন কঠিন প্রশ্ন তুলতে পারে। তাই ’৭৫-এর প্রতিরোধ যোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আশু প্রয়োজন।

প্রতিরোধযুদ্ধের সময়গুলো কষ্টের ছিল, ক্লান্তির ছিল। কিন্তু আনন্দও যে খুব একটা ছিল না তা নয়। বোন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নেত্রী শেখ হাসিনা তখন দিল্লির ডি ওও ১৬ পান্ডারা রোডের বাড়িতে থাকতেন। সেখান থেকে ’৭৬-এর সেপ্টেম্বরে লিখেছেন,

‘ভাই,

আপনার চিঠি পেয়েছি। উত্তর দিতে দেরি হয়ে গেল। কি লিখব বলেন? আপনাদের মুখ চেয়েই বসে আছি। অনেক দিন থেকেই যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হয় নাই। চিঠি পেয়ে যে কেমন লেগেছে বলতে পারব না। আপনারাই আমাদের ভরসা।

কি অন্যায় করেছিলাম যে আজ বাবা-মার কবরটা পর্যন্ত দেখতে পারব না। বাবার এত বড় ভালোবাসার মূল্য বাঙালি এভাবেই প্রতিদান দিল? তবে সবাই যে বিশ্বাসঘাতক না আপনারা তা প্রমাণ করেছেন। আমাদের সংগ্রামী অভিনন্দন রইল আপনাদের জন্য। বিশ্বাসঘাতকদের কোনোমতেই ক্ষমা করবেন না। দ্বিতীয় বিপ্লবকে সফল করতেই হবে এবং সেটাই হবে আপনাদের ও আমাদের ত্যাগের একমাত্র সার্থকতা।

ভাই, অনেক কথা লিখতে ইচ্ছে করে কিন্তু লেখার মতো মন ও ভাষা নেই। আমরা বেঁচে আছি দুটো অপদার্থ। দোয়া করবেন। আপনাদের পাশে আছি। দোয়া করবেন। চিঠির ব্যাপার সম্পূর্ণ গোপন রাখবেন।

খোদা হাফেজ

জয় বাংলা

ইতি আপনার বোনেরা।’

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বোন হাসিনা তখন আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করতেন। তিনি আমাকে তুমি এবং বজ্র বলে সম্বোধন শুরু করেন ’৭৮ সালের শেষ অথবা ’৭৯ সালের প্রথম সপ্তায়।

এবার বেগম নাসরীন সিদ্দিকীর পরামর্শে ধানমন্ডির বাড়িতে গেলাম না। মাঝে ৩২-এর বাড়ির গেট থেকে ফিরে আসায় আমার স্ত্রীর কথা, ‘ধৈর্য ধর। যখন সময় হবে আমরা যাব। তার চেয়ে বরং সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে সপরিবারে টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে পিতার কবরে ফাতিহা পাঠ করে আসি।’ পরামর্শটা মন্দ লাগেনি। তাই যাওয়া হলো না।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রিয় বোন আইয়ুব-ইয়াহিয়ার শত নির্যাতনে মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন নিয়ে ছায়ায়-মায়ায় মাখামাখি করেছিলাম। আমার ছোট তিনটে বোন সন্তানের মতো। অভাব ছিল বড় বোনের। তা-ও আপনি পূরণ করেছিলেন। আপনাকে সব সময় মায়ের মতোই দেখে এসেছি। আর আপনি ভালো করেই জানেন যে আমি মায়ের জন্য কী করতে পারি। বয়স হয়ে গেল, শরীর তেমন ভালো না। মানুষ সবাই ভুল করে, ছোটখাটো অন্যায়ও করে। তাই আমি কোনো ভুল করে থাকলে ক্ষমা করবেন। কখন কী হয় বলা যায় না। কখন আছি কখন নেই তাই যদি চলে যাই দয়া করে ক্ষমা করবেন। আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পরিবার-পরিজনসহ বেহেশতবাসী করুন।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর