রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

আমাদের পদ্মা সেতু

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার, এনডিসি (অব.)

আমাদের পদ্মা সেতু

পদ্মা নদী ভ্রমণকালে পদ্মা সেতু দেখার মিশন নিয়ে গ্রীষ্মের এক সকালে (মে, ২০২২) আমরা বেরিয়েছি। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামার পরই গাড়িগুলো দৃষ্টিনন্দন ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশ করল। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তৈরি, চোখ ধাঁধানো দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়েতে উঠে এক ধরনের রোমান্টিকতাও জাগে। গাড়িতে চড়েই যেন বিমানের অনুপম মুগ্ধতা। ইতিহাসসমৃদ্ধ মুন্সীগঞ্জ-বিক্রমপুর-শ্রীনগরের সবুজাভ জনপদের মধ্য দিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে থাকি। যাত্রাপথে চোখে পড়ে গ্রীষ্মের রঙিন ফুলগুলো- কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল...। খুব অল্প সময়েই পৌঁছে যাই সার্ভিস এরিয়া সংলগ্ন মাওয়া ক্যাম্পে। চোখে পড়ে পদ্মা সেতুর এপারের কর্মযজ্ঞ। ততক্ষণে থেমে গেছে বৃষ্টি। মাওয়া ক্যাম্পে খানিক বিরতির পর পৌঁছে যাই মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাটে। সেখান থেকে পদ্মায় চমৎকার এক প্যাট্রল বোটে ওঠা হলো।

সকাল প্রায় ১০টা। বৃষ্টি থামার পর নদীর চমৎকার শোভা। নরম রোদ। আমাদের আপাত গন্তব্য পদ্মার ওপারের কাঁঠালবাড়ী ঘাট। ভ্রমণ শুরুর কিছুক্ষণ পরই দূরে পদ্মা সেতুর অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়ে। পদ্মায় চলছে অসংখ্য জলযান- ফেরি, ট্রলার, লঞ্চ, স্পিডবোট, মাছ ধরার নৌকা...। মাছ ধরার নৌকাগুলোও ইঞ্জিনচালিত। মনে পড়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র কথা। এ যুগের কুবের, কপিলা, ধনঞ্জয়, হোসেন মিয়া, আমিনুদ্দিনদের অবস্থা কতটা বদলেছে? কেউ কি এদের খবর রাখে? বোটের অপারেটর তরুণ আবদুল কাদের পদ্মাপারের মানুষ। আমরা তার দেখা পদ্মা সেতু তৈরির রানিং কমেনট্রি শুনতে থাকি।

আমাদের দ্রুতগামী তরিটি পদ্মা সেতুর কাছে আসতে থাকে। এক পর্যায়ে নদীর মাঝখান থেকে আমরা প্রায় সম্পূর্ণ সেতুটি দেখতে পাই। অদ্ভুত এক ভালোলাগা আমাদের আচ্ছন্ন করে। বোটটি চলতে চলতে সেতুর একেবারে কাছে চলে আসে। অভিজ্ঞ চালক ছবি তোলার জন্য বোটের ইঞ্জিনটি বন্ধ করে দেন। একদম চোখের সামনে ধূসর রঙের কাক্সিক্ষত বিশাল সেতু। এক ধরনের রোমান্টিকতা, ভালোলাগা, মুগ্ধতা ও বিস্ময়ে কিছুক্ষণ আবিষ্ট হয়ে থাকি। এ ‘গ্রেট’ সেতুটি নির্মাণে জড়িত সবাইকে মনে মনে অভিবাদন জানাই। সেতুর পটভূমিতে যুগলে রোমান্টিক ভঙ্গিতে ছবিটবিও তোলা হয়। এরপর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দ্বিস্তরের ইস্পাত ট্রাস সেতুটির নিচ দিয়ে নদীর অন্য পাড়ে এগিয়ে যেতে থাকি।

বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং উন্নয়ন প্রকল্প এ পদ্মা বহুমুখী সেতু। আওয়ামী লীগ শাসনামলে, ১৯৯৯ সালে পদ্মা সেতুর প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিএনপি সরকারের সময়, ২০০৩ সালে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষার কাজ শুরু হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতুর কাজ হাতে নেয় এবং ২০০৭-এর আগস্টে একনেক সভায় পদ্মা সেতু প্রকল্প (শুধু সড়কসেতু) পাস করা হয়।

২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি ছিল। ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ হাতে নেন। ২০১১ সালে তিনি পদ্মা সেতুতে রেলপথ সংযোজনের নির্দেশ দেন এবং সেভাবেই সেতুর নকশা পরিবর্তন করা হয়। নকশা তৈরির জন্য নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনসেল এইকমকে নিয়োগ দেওয়া হয়। সরকারের পরিকল্পনা ছিল বিশ্বব্যাংকসহ কয়েকটি সাহায্যদাতা সংস্থার অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। স্বপ্নের সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হলো। কিন্তু আচমকা ছেদ। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। পদ্মা সেতুর কথিত দুর্নীতি নিয়ে মিডিয়ায় তখন তুমুল আলোচনা। দেশে-বিদেশে আলোচনা, সমালোচনা, বিরোধিতা ও বিতর্কের ঢেউ প্রমত্তা পদ্মার ঢেউকে যেন হার মানাল। ২০১২ সালে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল করে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তে ছিল অবিচল। ২০১৩ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়চিত্ত ও প্রচ- আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সংকল্প ব্যক্ত করেন। এ সাহসী সিদ্ধান্তই সবকিছু বদলে দেয়। অবশেষে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হলো পদ্মা সেতুর প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা। সুদক্ষ প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম এ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক, যার নেতৃত্বে চলেছে সেতু নির্মাণের কর্মযুদ্ধ। নির্মাণকাজ দুর্বার গতিতে চলে আজ এ সেতু বাস্তব। এসব ভাবতে ভাবতে সুবিশাল পদ্মা পেরিয়ে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী ঘাটে পৌঁছলাম।

কাঁঠালবাড়ী থেকে আশপাশের কয়েকটি স্থানে যাওয়া হলো। কৌশলগত কারণ ও নিরাপত্তার জন্য শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলায় গড়ে উঠেছে অত্যন্ত আধুনিক নির্মাণশৈলীর শেখ রাসেল সেনানিবাস। এখানে মোতায়েনকৃত ৯৯ কম্পোজিট ব্রিগেড সেতুর নির্মাণকাজে নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা প্রদান করছে। এ এলাকাটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য। বিশেষ করে মাদারীপুর ও শিবচর। জীবনের ওপারে চলে যাওয়া আমাদের বঙ্গবন্ধু হয়তো কখনো জানবেন না জাজিরায় তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র শেখ রাসেলের নামে একটি সেনানিবাস আছে। মানুষ মরে গেলে তার বয়স আর বাড়ে না। পরিচিত মানুষের স্মৃতিতে সেই প্রাণোচ্ছল নিষ্পাপ চেহারার শেখ রাসেলের বয়স এখনো নয়-দশ বছর।

অপরূপ বৃক্ষলতা ও ফুলে ফুলে ভরা জাজিরা ক্যাম্প/ এপারের সার্ভিস এরিয়ায় চমৎকার সময় কাটে। এখানে বিভিন্ন ব্যক্তির মিথস্ক্রিয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণের অনেক বিষয় জানা যায়। পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রাথমিক পর্যায়ে তৎকালীন সেতুমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের প্রশংসনীয় কর্মতৎপরতা ও দক্ষতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াও চমৎকার ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে দুঃখজনকভাবে তাঁদের দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়েছিল। সৈয়দ আবুল হোসেন তাঁর ‘আমি ও জবাবদিহিতা’ গ্রন্থে ওই সময়ের ঘটনাবলি সবিস্তার তুলে ধরেছেন। বর্তমান সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে চলেছে সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। সেতু বিভাগের সচিব ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন মো. মনজুর হোসেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে জাতীয় অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী অসাধারণ অবদান রেখেছেন। এই কিংবদন্তিতুল্য পুরকৌশল প্রকৌশলী ছিলেন সেতু প্রকল্পের আন্তর্জাতিক প্যানেল অব এক্সপার্টদের সভাপতি। উল্লেখ্য, এ প্যানেলে কর্মরত বাংলাদেশের প্রকৌশলী-অধ্যাপকরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিশেষত কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। ২০১৩ সালে সরকার, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পদ্মা সেতুর কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট (সিএসসি) হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওই সময়ে সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। পদ্মা সেতুর জন্য গড়ে ওঠে অস্থায়ী অ্যাডহক সিএসসি। হাতিরঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নের নায়ক মেজর জেনারেল আবু সাইদ মো. মাসুদ সিএসসির চিফ কো-অর্ডিনেটর হিসেবে অসাধারণ অবদান রেখেছেন। পদ্মা বহুমুখী প্রকল্পের ভৌত কাজকে মূলত পাঁচটি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। মূল সেতু, নদীশাসন, অ্যাপ্রোচ রোড, টোল প্লাজা ও সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ।

সেনাবাহিনীর সিএসসি দলটি পাঁচটির মধ্যে প্রথম তিনটি প্যাকেজের (অ্যাপ্রোচ রোড, টোল প্লাজা ও সার্ভিস এরিয়া) সুপারভিশন কনসালট্যান্সি অত্যন্ত দক্ষতা ও গতিশীলতার সঙ্গে সুসম্পন্ন করে। উল্লেখ্য, বুয়েটও (বিআরটিসি) এখানে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করে। এ তিনটি প্যাকেজের কন্ট্র্রাক্টর হিসেবে কাজ করে আবদুল মোনেম লি.। মূল সেতু নির্মাণের অনেক আগে, পরিকল্পিত সময়ের মধ্যে অ্যাপ্রোচ রোড ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মিত হওয়ায়, জনগণের মনে আশা জাগে যে পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন হয়, এটি বাস্তব হতে চলেছে।

পদ্মা সেতু ছাড়াও বর্তমানে চলমান মেগা প্রজেক্ট ‘পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পেও’ কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালট্যান্ট (সিএসসি) হিসেবে সেনাবাহিনী কাজ করছে। বর্তমানে সিএসসির চিফ কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল এফ এম জাহিদ হোসেন।

কাঁঠালবাড়ী থেকে শিমুলিয়া ঘাটে ফিরতি নৌভ্রমণ শুরু হয়। ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে গেছে। মূল নদীতে এলে বৃষ্টি শুরু হয়। আকাশ ঢেকে যায় কালো মেঘে। হঠাৎ উত্তাল হয়ে ওঠে নদী। পদ্মার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা সাহসী বোটচালক আবদুল কাদের আমাদের অভয় দেন। উত্তাল নদীতে দুলতে থাকা স্মার্ট নৌকায় বসে ভাবী, পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে কত ঝড়-ঝাপটাই না সামলাতে হয়েছে আমাদের সরকার ও প্রকৌশলীদের। কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই বর্তমান সরকার সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করেছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও অসাধারণ গতিশীল নেতৃত্ব ইতিহাস হয়ে থাকবে।

নদী কিছুটা শান্ত হলে একালের স্মার্ট মাঝি আবার সেতু নির্মাণের গল্প বলতে থাকেন। এটি এক নির্মাণ মহাযজ্ঞ। মূল সেতুর নির্মাণ প্রতিষ্ঠান (কন্ট্র্রাক্টর) চীনের চায়না মেজর সেতু ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লি.। অন্যদিকে নদীশাসনের কাজ করছে চীনের সিনোহাইড্রো করপোরেশন। খরস্রোতা পদ্মার বুকে ভাসমান বিশাল এ স্থাপনা নির্মাণের পেছনে রয়েছে বিরাট এক কর্মযজ্ঞের গল্প। ২০ দেশের বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী টেকনিশিয়ান, শ্রমিক, কর্মীসহ প্রায় ১২ হাজার মানুষের মেধা ও অক্লান্ত শ্রমে তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু। এ বড় প্রকল্পে বিদেশিদের পাশাপাশি বাংলাদেশি প্রকৌশলী ও কন্ট্রাক্টাররা কাজ করেছেন সমানতালে। চীনের নিবেদিতপ্রাণ শ্রমিক-প্রকৌশলীর সংখ্যা ১ হাজার ২০০। এর বাইরে প্রায় সবাই বাংলাদেশের। এ বড় কাজে ব্যবহৃত রড, সিমেন্ট, বালুর মতো উপকরণ বাংলাদেশেই তৈরি। সেতুর কাজ শুরুর পর এক দিনের জন্যও নির্মণকাজ বন্ধ রাখা হয়নি।

১৫ নম্বর স্প্যানের নিচ দিয়ে সেতু পার হচ্ছি। সেতুটিকে প্রকৌশল জগতের বিস্ময় বলা যায়। এতে বিশ্বের গভীরতম পাইল ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়েছে। নদীর তলদেশে মাটির ১২২ মিটার গভীরে পাইল বসানো ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিয়ারিং করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নদীশাসন ব্যবস্থাও এ প্রকল্পে। এসব কারণে সারা বিশ্বের প্রকৌশলীর মধ্যে এ সেতুর একটা বিশেষ অবস্থান আছে। এ সেতু নির্মাণে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রাকৃতিক ও প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জগুলো জয় করে শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে এ সেতু। এটি যেন প্রকৌশলীদের বসন্ত।

নদী আবার শান্ত হয়ে যায়। মুগ্ধ নয়নে চোখের সামনের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার বিশাল সেতুটি আবার দেখি। এ সেতু হতে চলেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গেম চেঞ্জার। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সোনালি ভবিষ্যৎকে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করে সার্বিক উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এটি শুধু প্রকৌশলগত অর্জন নয়, বরং একে প্রযুক্তি, শিক্ষা, উন্নয়ন, ভূরাজনীতি ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও মূল্যায়ন করা যেতে পারে। জাতির আকাক্সক্ষার প্রতীক সেতুটি অপেক্ষাকৃত অনুন্নত অঞ্চলের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। সেতুটি নির্মাণের ফলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে ধারণা করা হয়। সেতুটি নির্মাণের ফলে দক্ষিণাঞ্চল ট্রান্স-এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে।

একঝাঁক মায়াবী পাখি আমাদের যেন এসকর্ট করে শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছে দেয়। এভাবেই শেষ হয় পদ্মায় পারিবারিক নদী ভ্রমণ ও সেতু দর্শন। হয়তো এরপর সেতু থেকেই পদ্মার রূপ দেখব কোনো এক কোজাগরি পূর্ণিমায়। ঘাটের জনারণ্য পেরিয়ে আবার মাওয়া ক্যাম্প। বিকালে ঢাকার দিকে ফিরতি যাত্রা। আবার এক্সপ্রেসওয়ের মসৃণ যাত্রার মুগ্ধতা। দেশে আমরা অনেক বড় বড় স্থাপনা, অবকাঠামো তৈরি করেছি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এগুলোর মান ধরে রাখতে পারিনি। এ সেতুটি আমাদের সক্ষমতা ও আত্মবিশ্বাসের প্রতীক।

আমাদের মধ্যে বিভাজন, বৈষম্য বাড়ছে। তাই আমাদের প্রয়োজন সেতু। বাঁধ আর দেয়াল নয়। ব্রিটিশ কবি ফিলিপ লারকিন লিখেছেন- ‘একটি সেতুর দ্বারাই আমরা বাস করি।’ কারণ সেতুগুলোই আমাদের সংযোগের আকাক্সক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে। সেতুটি জনগণের সম্পদ। আমাদের অর্থায়নে তৈরি পদ্মা সেতু দুই পারের মানুষের সেতুবন্ধ ঘটিয়েছে, একত্রিত করেছে। জাতীয় ও সামাজিক জীবনে এখন প্রয়োজন পদ্মা সেতুর মতোই সেতুবন্ধ, ঐক্য, সম্মিলন, সংযোগ বন্ধন। পদ্মা সেতুর এ স্পিরিট ভবিষ্যতে আমাদের পথ দেখাবে। সেতু নির্মাণে জড়িত কর্মবীরদের অভিবাদন।

 

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, গবেষক।

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর