আজান শুনলে জবাব দেওয়া সুন্নত। যদি ব্যক্তিগতভাবে কেউ কোরআন শরিফ তেলাওয়াত করতে থাকে আর আজান শুরু হয়, তাহলে তেলাওয়াত আপাতত বন্ধ রেখে আজানের জবাব দেবে। কারণ কোরআন শরিফ তেলাওয়াত বন্ধ করে আজানের জবাব দিয়ে পুনরায় সেখান থেকে পড়লে তেলাওয়াতের সওয়াব ঠিকই পাওয়া যাবে, কিন্তু তেলাওয়াত বন্ধ করে আজানের জবাব না দিলে জবাব দেওয়ার সময় তো আর বসে থাকবে না। আপনি কোরআন শরিফ পড়ছেন বলে আজান বন্ধ থাকবে না। আজান তার নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং তেলাওয়াত ও আজান উভয়টির সওয়াব পাওয়ার তরিকা হলো- আজানের সময় তেলাওয়াত বন্ধ রেখে আজানের জবাব দেবে। আজান শেষ হলে আবার তেলাওয়াত শুরু করবে। বস্তুত আজানের জবাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এজন্য কোরআন তেলাওয়াত বন্ধ করে আজানের জবাব দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু ওয়াজ চলাকালে আজান হলে ওয়াজ বন্ধ করে আজানের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কারণ ওয়াজ কোনো ব্যক্তিগত আমল নয়, সমষ্টিগত আমল। বক্তা যদি ওয়াজ বন্ধ করে দেন তাহলে হাজারো মানুষের হক নষ্ট হবে। হক্কুল ইবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। আজানের সময় আল্লাহর হক- তেলাওয়াত মুলতবি রাখার নির্দেশ এসেছে; কিন্তু ওয়াজ বান্দার হক, এটা বন্ধ রাখার নির্দেশ নেই। হয়তো কোনো ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারেন যে, হুজুর! আজকে তো আপনি আমাদের ওয়াজ না শুনিয়ে চুপ করে বসে আজানের জবাব দিয়েছেন, এতে কি আমাদের হক নষ্ট হয়নি? আপনার প্রশ্ন ঠিক, যতক্ষণ আজান হয়েছে, আমি চুপ করে বসে আজানের জবাব দিয়েছি এবং আজান শেষে আজানের দোয়া পড়েছি। আজকে ওয়াজ না করে চুপ করে বসে থাকার দুটি কারণ রয়েছে।
১. আমার ওয়াজ শুরু করার আগেই অন্য মসজিদের আজানের শব্দ আমার কানে ভেসে এসেছে, তাই আমার জন্য করণীয় হলো আজানের জবাব দেওয়া। আর যদি আমার ওয়াজ শুরু করার পর আজান শুরু হতো, তাহলে আমার জন্য চুপ না থেকে ওয়াজ করে যাওয়াই উচিত হতো।
২. চুপ থেকে আরেকটি বিষয়ের প্রতি আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার উদ্দেশ্য। সেটা হলো- নামাজের সুন্নতের প্রতি আমাদের অবহেলা তো আছেই, তার চেয়ে বেশি রয়েছে অজুর সুন্নতের প্রতি, তার চেয়ে বেশি অবহেলা দেখা যায় আজানের জবাবের প্রতি। আপনারা অনেকে বুঝতে পেরেছেন যে, হুজুর চুপ করে বসে আজানের জবাব দিচ্ছেন, তথাপি জিজ্ঞেস করলে অসংখ্য লোক বের হবেন, যারা আজানের জবাব দেননি। অথচ সবাই নামাজের উদ্দেশ্যে মসজিদে এসেছেন। ১ ঘণ্টা ওয়াজ শোনার জন্য তৈরি হয়ে বসেছেন। মনের মধ্যে ইবাদতের এত আবেগ নিয়ে মসজিদে বসে থেকে আজান শুনেছেন, কিন্তু আজানের জবাব দেননি।
আমার এ উপলব্ধি হওয়ার কারণ হলো- আমি সারা দেশে মানুষকে সুন্নতের ওয়াজ করে শোনাই, কিন্তু অনেক সুন্নতের ব্যাপারে আমারই কোনো খবর নেই। একবার কোনো কারণে আমাকে পেরেশান হতে হয়েছে। যাওয়ার কথা নিকুঞ্জে, চলে গেছি কোনাবাড়ী। তখন মেজবান আমার কাছে মোবাইলে জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর! এখন আপনি কোথায়? আমি বললাম কোনাবাড়ীতে। তিনি বললেন, হুজুর! কোনাবাড়ী কেন, আপনার তো নিকুঞ্জে আসার কথা। আজ আপনার এখানে খানার দাওয়াত। আমি বললাম, আপনি জানেন না আমি কোথাও খানার দাওয়াতে যাই না। কোথাও গেলে খানা সঙ্গে নিয়ে যাই, অন্যথায় কোনো বন্ধুবান্ধব থাকলে প্রয়োজনে তার কাছে খানা খাই। কিন্তু সবার আগে আমার দীনের কাজ হতে হবে। যেখানে দীনের কাজ নেই, সেখানে আমার দাওয়াত খাওয়া হয় না। তিনি বললেন, একবার দাওয়াত দিলে আপনি বলেছেন, যেখানে ওয়াজ করেন, সেখানে খানা খান না। এজন্যই তো আজ ওয়াজের ব্যবস্থা করিনি। আজ শুধু খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আর এখন বলছেন, প্রথমে দীনের কাজ তারপর খাবার। আমি বললাম, এখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে আপনার পূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, আপনি যদি আমাকে বুঝতেন তাহলে এ প্রশ্ন করতেন না। আমার সেদিনের কথায় এবং আজকের কথায় যেহেতু আপনার মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে, এতে বোঝা গেল আপনি আমার ব্যাপারে ফ্রি হতে পারেননি। আপনার এ কথা কেন বুঝে এলো না যে, আমি সেদিন যে কথা বলেছি, সেটার উদ্দেশ্য ভিন্ন এবং আজকের কথার উদ্দেশ্য ভিন্ন। এতটুকু বিশ্বাস না করলে আপনি আমার সঙ্গে চলাফেরা করে শান্তি পাবেন না। আমি আপনার ওখানে আসব না। আমার সঙ্গে তার ৩০ বছরের পুরনো সম্পর্ক। এরপর এক লোক টেলিফোনে আমাকে জানাল, হুজুর! আপনাকে পাওয়ার জন্য সে হয়রান-পেরেশান হয়ে পড়েছে, এ মুহূর্তে আপনি সামনে থাকলে সে আপনার পায়ে লুটিয়ে পড়ত। তার বর্তমান অবস্থা এই যে, আপনি যদি না আসেন তাহলে হার্টফেল করে মারাও যেতে পারে। অগত্যা আমি আমার ড্রাইভারকে বললাম চল সেখানে যাই। কোনাবাড়ী থেকে ফিরে এসে এক মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করলাম। ইচ্ছা ছিল নামাজ শেষে তাড়াতাড়ি চলে আসব। কিন্তু নামাজ শেষে দাওয়াত ও তাবলিগের এক লোক এলান করলেন, ‘বাকি নামাজ বাদ ইমান-আমল সম্পর্কে জরুরি আলোচনা হবে, আমরা সবাই বসি, বহুত ফায়দা হবে।’ আমি সুন্নত পড়া শেষ করতে না করতেই তাবলিগের একজন আমির আমার সামনে বসে ফাজায়েলের কিতাবটি পড়তে আরম্ভ করলেন। এ মুহূর্তে কীভাবে উঠে আসব। সম্ভব হলো না। সাধারণত আলেমদের অভ্যাস হলো তাবলিগ জামাতের লোকেরা যখন ফাজায়েলের কিতাব পড়েন তখন তারা এমনকি স্বয়ং ইমাম সাহেবও মসজিদ থেকে বের হয়ে আসেন। এর ফলে দুটি খারাবি পরিলক্ষিত হচ্ছে-
১. কিছু লোক মনে করেন যে, আলেমরা তাবলিগ জামাতকে পছন্দ করেন না।
২. তাবলিগকারীদের মধ্যে যারা মূর্খ, তারা মনে করেন আলেমরা যেহেতু তাবলিগকে পছন্দ করেন না, তাই আমরাও তাদের সঙ্গে থাকব না; আমাদের আর আলেমের প্রয়োজন নেই। তারা আলেমদের বদনাম করে বেড়ান, আলেমদের সমালোচনা করে। এতে দীন ইসলামের কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তা বলে শেষ করা যাবে না। তাবলিগ জামাত যদি আজীবন চেষ্টা করে, তবু তারা সমাজে শান্তি আনতে সক্ষম হবে না, আমল আনতে পারবে না। কারণ আমলের জন্য ইলমের প্রয়োজন, ইলম ব্যতীত যত আমল করি, যত ফাজায়েল বয়ান করি, তাতে কোনো কাজ হবে না।
লেখক : আমির, আল হাইআতুল উলয়া ও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ