বিশিষ্ট কবি ও অভিনেতা সব্যসাচী চৌধুরীর কবিতার বই, ‘দলছুটের কলম’ থেকে প্রাসঙ্গিক লাইনগুলো দিয়েই লেখাটা আরম্ভ করছি। “এত রাগ, বিদ্বেষ, রাগ, অহঙ্কার কীসের
এই আজ আছি এটাই তো সত্য আগামীর কোনও
ভরসা নেই। তবে ভালো না বেসে এত ঘৃণা কীসের?
অনেক তো হলো, এবার থামুক কোলাহল। এবার না
হয় ভালোবাসার লেনা-দেনা হোক। ঘৃণা যাক না ঘুচে।”
সনাতন ধর্মমতে, এখন কলি যুগ চলছে। আমি বলি, এক কথায় বলা যায় বিশ্বে এখন ঘৃণার যুগ চলছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হচ্ছে বলে। তা ছাড়া ইসরায়েল সারা বিশ্বেই ঘৃণা ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে ইসরায়েলজনিত ঘৃণার হাওয়া বাংলাদেশে লাগেনি। বাংলাদেশে ‘বাংলাদেশ-মেইড-ইন’ ঘৃণায় ছেয়ে গেছে। আগামী দিনের যে কোনো ভরসাই নেই- সে কথাও মানুষ বেমালুম ভুলে গেছে বাংলাদেশে। এ যেন আদিম যুগে চলে গেছে দেশটি। প্রচণ্ড ঘৃণা থেকে খুনাখুনি চারদিকে ছেয়ে গেছে।
দূরদেশ থেকে একজন ইউটিউবারের প্ররোচনায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে অযথাই ঘৃণা প্রকাশ করছে কিছুসংখ্যক লোক। ইলন মাস্ক-সম মেধাবী ভদ্রলোক কীভাবে এত ঘৃণা ছড়াতে পারেন, তাঁর কথা না শুনলে বিশ্বাসই হবে না।
আমার প্রতিদিনকার সকালটা শুরুই হয় বেশ কয়েকটা পত্রিকা পড়ে। পত্রিকার খবরই আমি বিশ্বাস করি। ফেসবুক বা ইউটিউবারের কথা নয়।
বর্তমান বাংলাদেশে মৃত্যু অনেকটাই মূল্যহীন- নিতান্তই একটা সংখ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। আমার বিশ্বাস বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারছে না। এমনকি ক্ষমতায় যাঁরা আছেন তাঁরাও না। তাহলে কীসের ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ?
মানুষ ভালোবাসতে ভুলে যাচ্ছে। কবিগুরু কী করে শতাধিক বছর আগে বলে গেছেন, ‘সখী ভালোবাসা কারে কয়?’
ভালোবাসা বিশ্বব্যাপী একটি বহুল প্রচলিত রোমান্টিক শব্দ। স্পষ্টতই, এটি ইংরেজি ভাষার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একটি শব্দ এবং অন্যান্য কিছু ভাষায়ও বেশ ব্যবহৃত হয়।
ফিলাডেলফিয়া বেড়াতে গিয়ে আমরা সিটি হলের কাছে ‘লাভ’ ভাস্কর্য দেখতে গিয়েছিলাম।
ফিলাডেলফিয়া শুধু ভালোবাসার ভাস্কর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এটি একটি ঐতিহাসিক শহর, আপনি অনেক কিছু দেখতে পারেন এবং আপনি আপনার সময় উপভোগ করতে পারেন। আপনি শিল্পের জাদুঘরে যান বা ফ্র্যাঙ্কলিন ইনস্টিটিউট, লিবার্টি বেল, স্বাধীনতা হল এবং আরও অনেক কিছুতে যেতে পারেন। ইতিহাসে ভালো-খারাপ দুটোই থাকবে, তাই বলে ধ্বংস নয়। সুরক্ষা করতে হয়।
ভালোবাসা শব্দটি আমরা মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্যবহার করলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তা ব্যবহার করেছেন মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যিকারের ভালোবাসা এক অন্তহীন রহস্য, যা সৃষ্টির মূলে রয়েছে চূড়ান্ত সত্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে প্রেম একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ গুণ এবং এটি জীবনের প্রকৃত আনন্দের উৎস। আপনি যদি তাঁর কবিতা পড়েন বা তাঁর গান শোনেন, আপনি দেখতে পাবেন যে তিনি আপনাকে প্রেমের সঙ্গে ঈশ্বরের কাছে প্রণাম করতে বলছেন বা আপনি আপনার প্রেমিকের কথাও ভাবতে পারেন। কবিগুরু প্রণম্য।’
হিন্দু পুরাণ, মহাভারত অনুসারে অনেক আগে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ (হিন্দু অবতার হিসেবে বিবেচিত) বলেছিলেন, ‘শর্ত ছাড়া ভালোবাসা করা, উদ্দেশ্য ছাড়া কথা বলা, কারণ ছাড়াই দেওয়া, প্রত্যাশা ছাড়াই যত্ন করা, এটাই সত্যিকারের ভালোবাসার চেতনা।’ কবিগুরুও বিশ্বাস করতেন এবং পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন যে ভালোবাসার সারমর্ম হলো দেওয়া, নেওয়া নয়।
ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের মতে, প্রত্যেকের আল্লাহপ্রদত্ত মানবিক মর্যাদা অবশ্যই সম্মান করা উচিত, তার বিশ্বাস, জাতি, জাতিগত উৎস, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থাননির্বিশেষে। আর তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ডাকে তাদের গালি দিও না, পাছে তারা অজ্ঞতাবশত শত্রুতার বশবর্তী হয়ে আল্লাহকে অপমান করবে।
আমার এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনই চোখে পড়ল শাহ হারুন রশিদের একটি সুন্দর লেখা, ‘বিনয় আর ভালোবাসার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় যা দেখলাম।’ আমার প্রিয় লেখক, একসময়ের টক শো-খ্যাত শফিক রেহমান শিগগিরই লাল গোলাপের ভালোবাসা নিয়ে টেলিভিশনে আসছেন। একটা নির্মল আনন্দের অপেক্ষায় আছি।
লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও অঙ্ক বিভাগ, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইমান, কলম্বাস, যুক্তরাষ্ট্র