সমকালীন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান লেখক পশ্চিমবঙ্গের কথাসাহিত্যিক প্রয়াত সমরেশ মজুমদার। ওপার বাংলা তো বটেই, বাংলাদেশেও তাঁর ভক্ত-পাঠক অগণিত। তাঁর গল্প-উপন্যাস পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে। কথার ঠাস বুননে তিনি এমন জাল বিছিয়ে দেন যে পাঠক তা ছিন্ন করে বেরোতে পারে না। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, চিরন্তন প্রেম-ভালোবাসা, আনন্দ-বেদনার পাশাপাশি তাতে গণমানুষের কথা থাকে, রাজনীতির কথা থাকে। মানুষের শোষণ-বঞ্চনার চিত্র, তার সঙ্গে রাজনীতির ওপরতলা ও নিচতলার অনেক গোপন কথা তিনি অকপটে তুলে ধরেন। সমরেশ মজুমদারের ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ‘কালপুরুষ’ ও ‘মৌষলকাল’ উপন্যাস চতুষ্টয়ে পশ্চিমবঙ্গের পাঁচ দশকের রাজনীতির চালচিত্রের বর্ণনা রয়েছে। মানুষের কল্যাণসাধনের কর্মযজ্ঞ রাজনীতির অভ্যন্তরে যে কদর্যতা লুকিয়ে থাকে এবং তার গাড্ডায় পড়ে হাজারো তরুণের জীবন যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, সমরেশ মজুমদার তা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। রাজনীতির কুহেলিকায় সমাজ বদলের উন্মাদনা মোহগ্রস্ত তরুণদের কীভাবে ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়, তার বিবরণ রয়েছে ওই সব উপন্যাসে। পশ্চিমবঙ্গের বাম রাজনীতির আদ্যোপান্ত তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে। পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির দুভাগে বিভক্ত হওয়া, চারু মজুমদারের নেতৃত্বে এক অংশের চীনপন্থি লাইন গ্রহণ (নকশাল) এবং শ্রেণিশত্রু খতম করে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সরকার প্রতিষ্ঠার যে সশস্ত্র আন্দোলন গত শতাব্দীর ষাটের দশকের শেষার্ধে শুরু হয়েছিল, তার যবনিকাপাত পর্যন্ত অনেক কিছুই স্থান পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে। একসময় কলকাতায় যে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল যুব কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা, বামফ্রন্ট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সে জায়গা দখল করে বাম যুবফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা। বামফ্রন্টের সে রাজত্বের অবসান ঘটে তৃণমূল কংগ্রেসের উত্থানে। জনগণ অনেক নতুন কথা নতুন আশার বাণী শুনলেও স্বস্তির দিশা পায় না। মৌষলকাল উপন্যাসে সমরেশ মজুমদার দেখিয়েছেন কীভাবে যুব কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের নেতা-কর্মীরা তৃণমূল কংগ্রেসের তাঁবুতে আশ্রয় নেয়। পাশাপাশি পুলিশ এবং প্রশাসনও থেকে যায় একই ভূমিকায়। সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলার চলতে থাকে একই ফর্মুলায়, একই গতিতে। সমরেশ মজুমদারের উপন্যাসে বর্ণিত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির কদর্য চিত্র বিদ্যমান আমাদের দেশেও। এখানেও ক্ষমতার পালাবদল হয় ঠিকই, তবে রাজনীতির চালচিত্র পাল্টায় না। একশ্রেণির রাজনৈতিক কর্মী গিরগিটির মতো রং পাল্টে মিশে যায় নতুন স্রোতে। আর বীজগণিতের ‘সাইক্লিক অর্ডার’ ফর্র্মুলার মতো একই বৃত্তে আবর্তিত হয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি। পরিবর্তন যে একেবারে হয় না তা নয়। রাজনীতির মঞ্চে পাত্র-পাত্রী-কুশীলব ও সংলাপের পরিবর্তন হলেও বাকি সব থাকে ‘যথা পূর্বং, তথা পরং’। সে পরিবর্তনের সুফল আমজনতার কপালে জোটে না। সমাজে যেসব কর্ম অনৈতিক-অপরাধ হিসেবে গণ্য, সেগুলো ঘটমানই থাকে। কর্তার পরিবর্তন হয়, কর্ম একই থাকে।
সমরেশ মজুমদারের পাঠকপ্রিয় একটি উপন্যাস ‘সাতকাহন’। প্রায় হাজার পৃষ্ঠার এ উপন্যাসটি যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই রোমাঞ্চিত হয়েছেন ভাগ্যবিড়ম্বিত একটি প্রতিবাদী মেয়ের সমাজ ও রাজনৈতিক অব্যবস্থার প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াইয়ের বর্ণনায়। অত্যন্ত সুনিপুণ হাতে ‘দীপাবলী’ নামের মেয়েটির জীবন-সংগ্রামের চিত্র এঁকেছেন সমরেশ মজুমদার। অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার প্রত্যয় মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা দীপাবলীকে কী রকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে নিপতিত করে, তার বর্ণনার সঙ্গে আমাদের দেশের চিত্রও মিলে যায়। স্থানীয় প্রতাপশালী ব্যবসায়ী ও সমাজপতি ‘অর্জুন নায়েক’-এর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় মাঠপর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা দীপাবলি বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের ক্ষমতাবানদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে অর্জুন নায়েক ছিল আইনের ঊর্ধ্বে। ওই তল্লাটে তার কথাই ছিল আইন। সেই অতিশয় ক্ষমতাশালী অর্জুন নায়েক একদিন দীপাবলির কাছে আসে ওই এলাকার নির্বাচনে তার সমর্থিত এমএলএ (এমপি) প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার অনুরোধ নিয়ে। সবকিছু শোনার পরে দীপাবলি জিজ্ঞেস করে- অন্যকে জিতিয়ে অর্জুন নায়েকের কী লাভ? সে নিজে কেন ইলেকশনে দাঁড়ায় না? উত্তরে অর্জুন নায়েক বলে, ‘নির্বাচনে জিতে যারা নেতা হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে, বিধানসভায় ঢোকার মুখেই তাদের অহংকারের জুতোয় ফোসকা পড়ে। সেখানে আরও বড় নেতা, যারা মন্ত্রী কিংবা মুখ্যমন্ত্রী, তাদের কথাই শেষ কথা। আমার এই দলে যাওয়ার কী দরকার? বরং আমি একটা নেতা তৈরি করছি যে আমার কথা শুনবে, যা বলব তাই করবে। এতে কম আনন্দ বলুন? যেদিন অবাধ্য হবে সেদিন ছুড়ে ফেলে দিয়ে আর একজনকে নেতা বানিয়ে নেব। আড়ালে আবডালে থাকলাম অথচ কাজের কাজ হয়ে গেল।’
রাজনীতির নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নাড়ে যারা, সাতকাহনের অন্যতম চরিত্র অর্জুন নায়েকের মধ্যে আমরা তাদের সাক্ষাৎ পাই। তারা সবকিছুর মধ্যে থেকেও নেই। তাদের মধ্যে দেখা যায় সাধক কবিয়াল গোসাই রসরাজ তারকের গানের প্রতিরূপ- “আমার যেমন বেণী তেমনি র’বে চুল ভিজাবো না/ চুল ভিজাবো না, আমি বেণী ভিজাবো না/ জলে নামবো, জল ছড়াবো, জল তো ছোঁবো না।” এই জলে নেমে জল না ছুঁয়ে কার্যসিদ্ধিতে অভ্যস্ত মানুষের অভাব নেই আমাদের সমাজেও। তারা সব ক্ষেত্রেই বিরাজমান। সাদাচোখে তাদের স্বরূপ আন্দাজ করা মুশকিল। কারণ তারা এমন মুখোশ পরে থাকে, যেটা উন্মোচন না হওয়া পর্যন্ত তাদের আসল রূপটি কেউ ধরতে পারে না। তবে চোখ বন্ধ করে রাজনীতির অঙ্গনে দৃষ্টি মেললেই তাদের উপস্থিতি সহজেই ধরা পড়ে। এরা বরেরও মাসিমা, আবার কনেরও পিসিমা। এরা সাপের মুখে চুমো খায়, আবার বেজির গণ্ডদেশেও আদরের চিহ্ন এঁকে দেয়। তারা সব দলে সবখানে আছে, আবার কোনোখানে নেই। এরা নিজেরা রাজনীতি করে না, তবে রাজনীতি করায়। রাজনীতির রেসের ঘোড়ায় বাজি ধরে। পেছন থেকে কলকাঠি নেড়ে রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। অনেকটা মঞ্চ নাটকের পর্দার পেছন থেকে সংলাপ পড়ার মতো। যাকে বলা হয় ‘প্রোম্পট’ করা। এ প্রোম্পটাররা থাকেন মঞ্চের উইংসের আড়ালে। সেখান থেকে তারা সংলাপ পড়ে যান। দর্শকরা তাদের দেখতে পায় না। দেখার গরজও অনুভব করে না। অথচ নাটক মঞ্চস্থ করার পেছনে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কারণ পর্দার পেছন থেকে অনুচ্চ স্বরে আওড়ানো তাদের সংলাপ মঞ্চে উচ্চৈঃস্বরে উচ্চারণ করেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। সংলাপের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে হাত-পা নেড়ে, মুখে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে চরিত্রকে উপস্থাপন করেন দর্শকদের সামনে। দর্শক তা দেখে হাততালি দেয়, পছন্দ না হলে ধুয়ো ধুয়ো ধ্বনি দেয়, কখনো ছুড়ে মারে টম্যাটো বা ডিম।
কিন্তু পর্দার পেছনের প্রোম্পটারদের কেউ দেখে না। তারা আড়ালে থেকেই যান। এতে ভালো-মন্দ দুটোই অবশ্য আছে। ভালোটা হলো প্রোম্পট করতে ভুলের কারণে নাটক ফ্লপ করলে দোষ পড়ে নাটকের পাত্র-পাত্রীদের ওপর। আর মন্দটা হলো নাটক সফল হলে প্রশংসা পায় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই, প্রোম্পটারদের ভাগ্যে তা জোটে না। নাটকের প্রোম্পটাররা নিঃস্বার্থে কাজ করলেও রাজনীতির এসব প্রোম্পটার স্বার্থহীনভাবে কাজ করেন না। তারা তাদের স্বার্থকে হাসিল করার জন্যই পর্দার পেছন থেকে ভূমিকা রাখেন। তারা নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে সব সময় কাজ করেন এমনও নয়। যখন যেদিকে বায়ুপ্রবাহ প্রবল দেখেন, নায়ের বাদাম তোলেন সেদিকেই। কোনো কোনো সময় আড়ালে থেকে কাজ করেন একাধিক দলের জন্য। এতে সুবিধা আছে। বিনিয়োগ করা পুঁজি মার খায় না।
সম্প্রতি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান বলেছেন, ‘রাজনীতি কোনো পেশা নয়, রাজনীতি কোনো ব্যবসাও নয়। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ মার্চ ২০২৫)। ড. আবদুল মঈন খানের বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমতের কোনো প্রশ্নই আসে না। রাজনীতি কারও পেশা যেমন হতে পারে না, তেমনি ব্যবসায়ের মাধ্যমও হতে পারে না। অতীতে যাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় রাজনীতিবিদ ছিলেন, তাঁদের নিজস্ব একটি পেশা থাকত সংসার-ব্যয় নির্বাহের জন্য। রাজনীতিকে তাঁরা গ্রহণ করতেন দেশ ও মানুষের কল্যাণ সাধনের ব্রত হিসেবে। আজকাল তেমনটি খুঁজে পাওয়া ভার। রাজনীতি এখন অনেকেরই মূল পেশা। অতীতে রাজনীতিতে এসে কেউ কেউ নিঃস্ব হয়েছেন। আর আজ নিঃস্বরা রাজনীতিতে এসে গড়ে তোলে বিত্তবৈভব। কবি হেলাল হাফিজ তাঁর ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতায় বলেছেন, ‘মিছিলে কেউ আসে জ্বালাতে বা জ্বালিয়ে সংসার/ কেউ আসে সাজিয়ে বা সাজাতে সংসার।’ রাজনীতিতেও এখন চলছে সংসার সাজানোর প্রতিযোগিতা। কেউ সরাসরি রাজনীতিতে ঢুকে তা সাজায়, আর কেউ নেপথ্যে থেকে সাজিয়ে নেয় নিজের বিত্ত-প্রাসাদ।
রাজনীতির নেপথ্য এ কুশীলবের সংখ্যা কিন্তু কম নয়। তারা রাজনীতির পেছনে টাকা লগ্নি করে। নিঃস্বার্থভাবে নয়, আশায়। সে আশা সমর্থিত ব্যক্তি বা দল জিতে গেলে লগ্নি করা অর্থ কয়েক গুণ বাড়িয়ে আদায় করে নেওয়ার। দল হারলেও এরা হারে না। কেননা শক্তিধর সব পক্ষকেই এরা অর্থ সাহায্য করে থাকে, গোপন সম্পর্কও রাখে। ফলে যে দলই হারুক, তারা জিতে যায়। ক্ষমতাসীনদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসায়িক স্বার্থ আদায়ে এরা তৎপর থাকে। সরকারও এদের ঘাটায় না।
সেই কবে থেকে শুনে আসছি, সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সিন্ডিকেটের কারণে। গত বছর গতায়ু হওয়া সরকারটির আমলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি (বর্তমানে জেলখানার বাসিন্দা) নিজেই স্বীকার করেছিলেন, সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী। মন্ত্রী মহোদয়ের কথা শুনে দেশবাসী হয়েছিল হতভম্ব। কারণ সাধারণ মানুষ সরকারকে কল্পনা করে প্রবল শক্তিধর সত্তা হিসেবে। তারা দেখে অভ্যস্ত সরকার তার বিরোধী মতাবলম্বীদের কীভাবে শক্ত পেশিতে দমিয়ে রাখে, ইস্পাতকঠিন হাতের আঙুল কীভাবে টিপে ধরে গণমাধ্যমের গলা। তাই সরকারের চেয়ে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী শক্তিশালী হতে পারে এটা কেউ কল্পনাও করতে পারে না। অথচ দেশবাসী নির্বাক দৃষ্টিতে দেখেছে, কথিত সিন্ডিকেটের কাছে সরকারের অসহায় আত্মসমর্পণ। সিন্ডিকেটের কাছে গত সরকারটির অসহায়ত্বের গোমর ফাঁস করে দিয়েছিলেন ওই সরকারেরই প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদার। বলেছিলেন, সরকারের মন্ত্রীরা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকায় তাদের নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বলা বাহুল্য, এ বাজার সিন্ডিকেট সাতকাহন উপন্যাসের অর্জুন নায়েক।
রাজনীতি একটি রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চালিত করবে, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু রাজনীতির মানুষরা যখন অর্জুন নায়েকদের দ্বারা প্রভাবিত হন, তখন আর তা সঠিক পথে চলে না, বিপথগামী হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ক্ষমতার পালাবদলে একদল ছিটকে পড়লেও, অর্জুন নায়েকরা রয়ে যায় বহাল তবিয়তে। কেউ তাদের কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারে না।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক