ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদকে (ডাকসু) বলা হয় দেশের দ্বিতীয় পার্লামেন্ট। আন্দোলন-সংগ্রামের তীর্থভূমি বলে পরিচিত ডাকসু। বায়ান্ন, বাষট্টি, ছিষট্টি, উনসত্তর, সত্তর, একাত্তর, নব্বই ও চব্বিশের ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার এটি। ৯ সেপ্টেম্বর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। দেশবাসীর চোখ এখন সেদিকে নিবদ্ধ। এবার ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে কোনো দলীয় সরকার ছাড়া। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায়। ডাকসু নির্বাচনের সঙ্গে যে ছাত্রসংগঠনটির নাম ভালো-খারাপে জড়িত সেই ছাত্রলীগ এখন নিষিদ্ধ। স্বীকার করতে হয় এর আগের সব ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের সদম্ভ উপস্থিতি ছিল। এবারের ডাকসু নির্বাচনে কোনো ছাত্রসংগঠনের একক প্রভাব নেই। দীর্ঘ সাড়ে পনেরো বছর ফ্যাসিস্ট সরকার ক্ষমতায় ছেপে বসে প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনগুলোকে ক্যাম্পাসে দাঁড়াতেই দেয়নি। সবচেয়ে বেশি অত্যাচারের শিকার হয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। অথচ ছাত্রদের মাঝে এই সংগঠনটির জনপ্রিয়তা ছিল বেশি।
৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠেয় ডাকসুতে ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে নির্বাচন করছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল থেকে মো. আবিদুল ইসলাম খান, শেখ তানভীর বারী হামিম ও তানভীর আল হাদী মায়েদ; বাংলাাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাদিক কায়েম, এসএম ফরহাদ ও মহিউদ্দিন খান; বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের আবদুল কাদের, আবু বাকের মজুমদার ও আশরেফা খাতুন; স্বতন্ত্র প্যানেলের উমামা ফাতেমা, আল সাদী ভূঁইয়া ও জাহিদ আহমেদ; বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের বিন ইয়ামিন মোল্লা, সাবিনা ইয়াসমিন ও রাকিবুল ইসলাম; ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ-এর ইয়াসিন আরাফাত, খায়রুল আহসান মারযান ও সাইফ মোহাম্মাদ আলাউদ্দিন; প্রতিরোধ পর্ষদ নামে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর শেখ তাসনিম আফরোজ ইমি, মেঘমল্লার বসু ও মো. জাবির আহমেদ জুবেল; স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংসদ জালালুদ্দিন মুহাম্মদ খালিদ ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (বহিষ্কৃত) মো. মাহিন সরকার; লক্ষ্মীপুর জেলা ছাত্রছাত্রী কল্যাণ সমিতি থেকে ফাতেহা শারমিন এ্যানি; তিনটি বামপন্থি ছাত্রসংগঠন মো. নাইম হাসান, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ), এনামুল হাসান অয়ন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ), অদিতি ইসলাম (বাংলাদেশ ছাত্রলীগ-বিসিএল)। এ ছাড়াও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত সানজিদা আহমেদ তন্বী গবেষণা ও প্রকাশনা সম্পাদক পদে মনোনয়ন সংগ্রহ করেন। দেশ স্বাধীনের পর ৫৪ বছরে ডাকসু নির্বাচন হয়েছে মাত্র আটবার। মুক্তিযুদ্ধের পর প্রথম ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালে। সেবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে। সবশেষ ডাকসু নির্বাচন হয় ২০১৯ সালে। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর ভিপি নির্বাচিত হন। জিএস ও এজিএস নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গোলাম রাব্বানী ও সাদ্দাম হোসেন। অতীতের ডাকসু নির্বাচনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্বাধীনতার পর প্রায় সব নির্বাচনে সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠনই সাফল্য পেয়েছে। যদিও ২০১৯ সালের নির্বাচন ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। সে সময় দেশের ক্ষমতায় ছিল স্বৈরশাসক। যার সহযোগী সংগঠন ছিল বর্তমানে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৭২
মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ২০ মে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় আটটি ছাত্রসংগঠন ভোটে অংশ নেয়। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মধ্যে। ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। জিএস একই সংগঠনের মাহবুব জামান। ছাত্রলীগের দুটি অংশের মধ্যে শহীদ-মনির পরিষদ (শেখ শহীদুল ইসলাম ও মনিরুল হক চৌধুরী) একটি পদেও জয় পায়নি। আর শাজাহান সিরাজের নেতৃত্বাধীন সিরাজপন্থি ছাত্রলীগের জিনাত-মোয়াজ্জেম প্যানেল (জিনাত আলী ও মোয়াজ্জেম হোসেন) ডাকসুর একটি সদস্যপদে নির্বাচিত হন।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৭৩ (ফলাফল স্থগিত)
১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হলেও শেষ পর্যন্ত ফল ঘোষণা হয়নি। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। সেবার বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জোট গঠন করে। এই জোটের প্যানেলে ভিপি প্রার্থী ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের নূহ-উল-আলম লেনিন এবং জিএস পদে ছিলেন ছাত্রলীগের ইসমত কাদির গামা। জাসদ-সমর্থিত ছাত্রলীগ আলাদা প্যানেল দেয়। তাদের ভিপি ও জিএস প্রার্থী ছিলেন মাহবুবুল হক ও জহুরুল ইসলাম।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৭৯
কয়েক বছর পর ১৯৭৯ সালের ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। তখন দেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নেয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। সংগঠনটি ডাকসুতে সেবার কোনো পদ না পেলেও হল সংসদে ভিপি, জিএসসহ কয়েকটি আসন পায়। সেবার আলাদাভাবে মাঠে নামে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। এই নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না। একই প্যানেলের আখতারুজ্জামান জিএস নির্বাচিত হন। ডাকসুর ১৯টির মধ্যে ১৫টি পদে জয় পায় মান্না-আখতার প্যানেল। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রলীগের (কাদের-চুন্নু) পরিষদের ওবায়দুল কাদের ও বাহালুল মজনুন চুন্নু। ছাত্রদলের ভিপি ও জিএস প্রার্থী ছিলেন (শহীদ-নজরুল) এনামুল করিম শহীদ ও নজরুল ইসলাম।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৮০
স্বাধীনতার পর চতুর্থ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালের ১১ নভেম্বর। এই নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো ভিপি নির্বাচিত হন মাহমুদুর রহমান মান্না এবং জিএস আখতারুজ্জামান। আগের নির্বাচনে তাঁরা ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের, এবার অংশ নেন নবগঠিত বাসদ ছাত্রলীগের ব্যানারে। মান্নার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রলীগের কাদের-চুন্নু পরিষদের ওবায়দুল কাদের। ভিপি পদে ছাত্রদলের মিলন-কামাল পরিষদের প্রার্থী ছিলেন গোলাম সারোয়ার মিলন। জিএস পদে জয়ী হন আখতারুজ্জামান। প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রলীগের বাহালুল মজনুন চুন্নু ও ছাত্রদলের এম এ কামাল।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৮২
১৯৮২ সালের ডাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে জয় পান বাসদ ছাত্রলীগের আখতারুজ্জামান। জিএস পদে নির্বাচিত হন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। ছাত্রদলের গোলাম সারোয়ার মিলন ও নজরুল ইসলামের (মিলন-নজরুল) নেতৃত্বাধীন প্যানেল হল সংসদে শক্ত অবস্থান তৈরি করে। ১১টি হল সংসদে মোট ১৩২ আসনের মধ্যে ছাত্রদল জয় পায় ৬৫টিতে। ডাকসুতে এজিএসসহ চারটি পদে জয়ী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চলে আসে জিয়াউর রহমান প্রতিষ্ঠিত দলটি। এজিএস নির্বাচিত হন ছাত্রদলের গোলাম মোস্তফা।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৮৯
দীর্ঘ সাত বছর বিরতির পর ১৯৮৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ডাকসু নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র মৈত্রী, বাসদ ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্রলীগ (মু-না) এবং ছাত্রলীগ (সু-র) মিলে গঠন করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। নির্বাচনে ডাকসুর সব পদে জয় পায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ভিপি নির্বাচিত হন ছাত্রলীগ (সু-র) সভাপতি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ, জিএস হন জাসদ ছাত্রলীগের (মু-না) সভাপতি মুশতাক হোসেন এবং এজিএস হন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নাসির-উদ- দৌজা। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন দুদু-রিপন-খোকন পরিষদের প্যানেলে ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শামসুজ্জামান দুদু, ওই সময়ের সভাপতি আসাদুজ্জামান রিপন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদল নেতা খায়রুল কবির খোকন।
ডাকসু নির্বাচন : ১৯৯০
১৯৯০ সালের ডাকসু নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হয় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। প্রচারণায় ছাত্রদল সামনে আনে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের অঙ্গীকার, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাড়া ফেলে। এই নির্বাচনে ভিপি পদে জয়ী হন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আমান উল্লাহ আমান, জিএস খায়রুল কবির খোকন ও এজিএস নাজিম উদ্দিন আলম। ফলাফলে দেখা যায়, ডাকসু ও হল সংসদ মিলিয়ে মোট ১৮৮ আসনের মধ্যে ১৫১টিতেই বিজয়ী হয় ছাত্রদল। ছাত্রলীগের শাহে আলম ও কামরুল আহসানের (আলম-কামরুল) নেতৃত্বাধীন প্যানেল দুটি হলে পূর্ণ প্যানেলে জয় পায়। অন্যদিকে রোকেয়া, শামসুন্নাহার ও এ এফ রহমান হলে সাতটি পদ দখল করে ছাত্র ইউনিয়ন।
ডাকসু নির্বাচন : ২০১৯
প্রায় ২৯ বছর পর ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেবার ভিপি পদে নির্বাচিত হন বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর। জিএস ছাত্রলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও এজিএস সাদ্দাম হোসেন। নুরুল হক নুরের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী। এই নির্বাচনের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নিয়েছিল ছাত্রলীগ। প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলকে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়। তারপরও ঐতিহ্যবাহী ছাত্রদল সেবার ডাকসুতে ভিপি, জিএস ও এজিএস পদে মনোনয়ন দেয় যথাক্রমে মোস্তাফিজুর রহমান, আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক ও খোরশেদ আলমকে।
লেখক : সাংবাদিক