বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০১৫ ০০:০০ টা

হুমায়ূনের ঈদ

মেহের আফরোজ শাওন

হুমায়ূনের ঈদ

নির্দিষ্ট কোনো দিনে হুমায়ূন আহমেদকে বেঁধে রাখা যাবে বলে আমি মনে করি না। হোক সেটা ঈদ, নয় তো বইমেলাতে নতুন কোনো বইয়ের মোড়ক উন্মোচন। সর্বক্ষেত্রেই এখন তার ছায়া অনুভব করি। আর ঈদের দিন বাবার মতোই একই ধরনের পাঞ্জাবি পরে বাবার আঙ্গুল ধরে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছে দুই ছেলে নিষাদ-নিনিত- এ দৃশ্য ভুলতে পারছি না। এ সুন্দর দৃশ্যটিই খুব মিস করি গত কয়েক ঈদে। ওদের বাবা হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন, আর কোনো দিনই ফিরবেন না। তাই এক পোশাকে বাবার সঙ্গে নামাজ পড়তে যেতে আর কখনো পারবে না ছেলেরা। কিন্তু নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন শুয়ে আছেন। বাবার কাছাকাছি থেকে যেন ওরা নামাজ পড়তে পারে, সে জন্যই এর আগে নুহাশ পল্লীতে ঈদ করতে গেছি। এবারও পরিকল্পনা আছে ঈদের দিন সকালে নুহাশ পল্লীতে যাব। এরপর দুপুরে ঢাকায় ফিরব।   

বেঁচে থাকাকালে হুমায়ূন আহমেদ আর নিষাদ-নিনিতের সঙ্গী হতেন নুহাশ হুমায়ূনও। নুহাশ দেশে থাকলে তাকে আনতে গাড়ি পাঠানো হতো। নুহাশও তার বাবা ও নিষাদ-নিনিতের মতোই একই ধরনের পাঞ্জাবি পরতেন। তারপর চারজনে একই ধরনের পোশাকে একসঙ্গে নামাজ পড়তে যেতেন। আমার ছোট ছেলেটি (নিনিত) খুবই ছোট, বোঝার মতো বয়স ওর হয়নি। এখনো মাঝে মাঝেই ফোন তুলে বলে ওঠে, বাবা, বলো। তবে বড় ছেলেটি (নিষাদ) হয়তো কিছুটা বুঝতে পারে। বেঁচে থাকতেই হুমায়ূন তাকে দূর মহাকাশ (আউটার স্পেস), মহাকাশচারী- এসব নিয়ে বলতেন, বোঝাতেন। তাই বুঝি বা, নিষাদ বাবা মারা যাওয়ার প্রথম দিকে বলত, বাবা আউটার স্পেসে আছে চিকিৎসার জন্য। তবে এখন বোধহয় মৃত্যুর বিষয়টি ও কিছুটা অনুভব করতে পারে। নিনিত জন্মের পর প্রথম ঈদ পায় ৪ দিন বয়সে, আর নিষাদ ৯ মাসে। প্রথম দিকে হুমায়ূন আহমেদ ছেলেদের কোলে নিয়ে নামাজে যেতেন। পরের দিকে ওরা হাঁটতে শিখলে বাবার আঙ্গুল ধরে নামাজে যেত ওরা। নিজের পোশাক নিয়ে খুবই উদাসীন ছিলেন হুমায়ূন। আমিই মিলিয়ে একই ধরনের পাঞ্জাবি বানিয়ে দিতাম বাবা-ছেলেদের। এই একই পোশাকে নামাজ পড়াটাকে তিনি খুবই উপভোগ করতেন। বলতেন, আমরা একটা ফুটবল টিম যাচ্ছি নামাজ পড়তে। ফিরে এসে খুব মজা করতেন, একসঙ্গে ছবি তুলতেন। ছেলেরাও এটা খুবই উপভোগ করত। কেননা, ঈদের দিন খুব ভোরে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে গোসল করিয়ে তৈরি করতাম। ছোট বাচ্চারা এতে বিরক্ত হয়। কিন্তু ওরা মোটেই বিরক্ত হতো না। আনন্দের সঙ্গেই তৈরি হতো।   

হুমায়ূন একা ঈদ করতে পছন্দ করতেন না। আসলে তিনি কোনো কিছুই একা করতেন না। সবকিছুই করতেন দলবল নিয়ে, আয়োজন করেই। রোজার মাসটাকেও তিনি পছন্দ করতেন। ঈদের জন্য নয়, ইফতারের জন্য। বেশ আয়োজন করে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ইফতার করতেন তিনি। ঈদের দিনে আমরা ঢাকায়ই থাকতাম। ঈদের পরদিন নুহাশ পল্লীতে যেতাম। ঈদের দিন দুপুরে হুমায়ূনের বন্ধুরা আসতেন। সবাই মিলে হৈচৈ হতো। হুমায়ূন তার বন্ধুদের সঙ্গে খুব জমিয়ে আড্ডা দিতেন। রাতে আমার মায়ের বাড়িতে যেতাম। হুমায়ূন তার সব বন্ধু-বান্ধবকে নিয়েই যেতেন। ঈদের দিন দুপুরে সব রান্না আমিই করতাম। তিনি (হুমায়ূন) আমার রান্না খুব পছন্দ করতেন। পোলাও, রোস্ট, গরুর মাংস, গরুর কলিজা যাই রান্না করতাম, তাই মজা করে খেতেন। হুমায়ূন আহমেদ উপহার দিতেও খুব পছন্দ করতেন। তবে সবকিছু কেনার লিস্ট আমাকে দিতেন। লিস্ট অনুযায়ী আমি উপহারগুলো কিনতাম। একবার আমাকে বললেন, লিস্টের বাইরে দুটি পাঞ্জাবি কিনতে হবে। আমি বললাম, কার জন্য কিনতে হবে, তিনি কিছু বললেন না। পাঞ্জাবি কেনার পর সেটি নিয়ে চলে গেলেন সোজা নিউমার্কেটে। সেই মাছ বিক্রেতার হাতে তুলে দিলেন সেটি। এতে মাছ বিক্রেতা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আরেকটা পাঞ্জাবি দিলেন মাংসের দোকানের সেই কসাইকে। তাদের খুশি দেখে হুমায়ূন আহমেদেরও চোখ ভিজে গেল।  

অনুলিখন : শামছুল হক রাসেল

 

সর্বশেষ খবর