সোমবার, ২৫ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা
২৫ দিনে ২০ ছবি

ঘোষণাতেই ছবি শেষ...

আলাউদ্দীন মাজিদ

ঘোষণাতেই ছবি শেষ...

ঢাকঢোল পিটিয়ে জমকালো মহরত করা হলো। অনেক ছবির ক্ষেত্রে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ক্লাপস্টিক দেন মন্ত্রী। রীতিমতো হইচই কান্ড, ঘোষণা দেওয়া হলো বিগ বাজেট আর অ্যারেঞ্জমেন্টের ছবি হবে এটি। দর্শক এবার অন্যরকম একটি ছবি পেতে যাচ্ছে। যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। ব্যস, ওই পর্যন্তই। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ছবির আর কোনো খবর থাকে না। মানে ছবিটি আসলেই অন্যরকম[!] হয়ে যায়। কিন্তু কেন?

চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায়- যারা ঘোষণা বা মহরতে ছবি শেষ করে তাদের অবশ্যই অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে। মহরত করে বা ঘোষণা দিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে নানা ফায়দা লুটে। এখন তো স্পন্সরের যুগ। যে কেউ চাইলেই নামমাত্র প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে সহজে স্পন্সর জোগাড় করে পকেটভর্তি করতে পারেন। চলচ্চিত্রশিল্পের অবস্থা নামধারী এই নির্মাতারাই খারাপ করছেন। প্রযোজককে একদিকে এ ব্যবসায় লাভবান হওয়ার, অন্যদিকে নায়িকা নিয়ে ফুর্তি করার লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছেন। অনেক প্রযোজক আবার তাঁর ছবিতে মেয়েদের নায়িকা করার প্রলোভন দেখিয়ে তাঁকে নিয়ে লং ট্যুরে যান, ফুর্তি করেন। বিভিন্ন সেক্টরের উচ্চপদস্থ কর্তা ব্যক্তিদের মনোরঞ্জন করিয়ে নিজের ফায়দা হাতিয়ে নেন। ব্যস, এখানেই সব শেষ। ছবি আর নির্মাণ হয় না। এভাবে প্রতিবছরই শতাধিক ছবির ঘোষণা আসে। চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক সমিতিতে ছবির নামও এন্ট্রি হয়। বছর শেষে ছবি মুক্তির সংখ্যা পঞ্চাশের ঘরও পেরোয় না। এই চিত্র গত প্রায় এক দশকের। চলতি বছরও মনে হয় সেই পথে হাঁটছে ঢালিউড। বছরের প্রথম মাসের গতকাল পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ ছবির ঘোষণা এসেছে বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থা থেকে। এর মধ্যে মহরত হওয়া দু-একটি ছবির শুটিং শুরু হলেও তা নামমাত্র। ২০ ছবির ঘোষণার মধ্যে রয়েছে ডিপজল প্রযোজিত সাতটি ছবি, শাপলা মিডিয়ার তিন ছবি,  মো. ইকবাল প্রযোজিত, পরিচালিত তিন ছবি এবং অনন্য মামুন পরিচালিত পাঁচটি ছবি। এ ছাড়া মৌসুমী-ওমর সানীকে নিয়ে ‘বাংলার ভাবী’ শিরোনামের একটি ছবির শুটিং বছরের শুরুতে শুরু হলেও অল্প সময়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। ৬ জানুয়ারি ডিপজল যে সাতটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন তার মধ্যে ১৫ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে মাত্র একটি ছবি মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘মানুষ কেন অমানুষ’ এর কাজ। ১৮ জানুয়ারি শাপলা মিডিয়া প্রযোজিত ও ঘোষিত তিনটি ছবি হলো- ‘লাইভ’, ‘নরসুন্দরী’ ও ‘গ্যাংস্টার’। অনন্য মামুন চলতি মাসে পাঁচটি সিনেমা বানানোর ঘোষণা দিয়েছেন। ছবিগুলো হলো-প্যাড, ক্রেজি, ঈদ মোবারক, ভাইজান ২ ও পাইলট। ২০ জানুয়ারি তিনটি সিনেমার ঘোষণা দিয়েছেন প্রযোজক মো. ইকবাল। ছবিগুলো হলো- ‘ফাইটার’, ‘রিভেঞ্জ’ এবং ‘গুলশানের চামেলি’। এর মধ্যে ইকবালের ‘গুলশানের চামেলি’ ছবির ঘোষণা এসেছিল এক বছরেরও বেশি সময় আগে। এ ছবির নায়িকা হিসেবে তিনি একেক সময় কলকাতা ও ঢাকার একেক নায়িকার কথাও জানিয়েছিলেন। এসব ছবি কখন বড় পর্দা আলোকিত করবে এখন সেটিই দেখার বিষয়।

গত কয়েক বছরে যেসব ছবি মহরতে শেষ হয়েছে বা নামমাত্র কিছু শুটিং হয়েছে সেসবের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- চাইলাম যারে পাইলাম না তারে, মন খোঁজে বন্ধন, দেহ, ৬৯ পাতলা খান লেন, মায়ানগর, জলে ভাসা পদ্ম, জালালের পিতাগণ, না মানুষ, হাডসনের বন্দুক, মুন এভিনিউ, প্রিয়তমা আমি দাঁড়ি তুমি কমা, টাইম মেশিন, ফিল মাই লাভ, আসব না ফিরে, লাভ ইন কোরিয়া, কিস্তির জ্বালা, ভালোবাসার চাইতে একটু বেশি, বিচার আমি করব, লাইলী মজনু, আমার পিরানের কোনো মাপ নাই, আবার যোদ্ধা হব, তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা, প্রবাসীর প্রেম, সালাম মালয়েশিয়া, এলিয়েন এখন ঢাকায়, নষ্ট ছেলে, কেন আমি আসামি, বউ পাগল, কালো বিড়াল, পাগলের বিয়ে, মন যারে চায়, কাটা দাগ, মিশন সিআইডি, সাহসী কন্যা, নবীন কমিশনার, জনতার ডাক, নীলাঞ্জনা, সুন্দরী গুলবাহার, আদম, সবুজ কেন অপরাধী, আগুনমুখী, রক্তাক্ত প্রেম, প্রেমের নদী, নষ্ট হওয়ার কষ্ট, বিয়ে হলো বাসর হলো না, মধুর জীবন, না বলা ভালোবাসা, এইতো সময় ভালোবাসার, হ্যালো অমিত, পারলে  ঠেকা, আগুনের চোখে প্রেম, অন্তরে অন্তরে, ভালো লাগার চেয়ে একটু বেশি, প্রেমের কাজল, প্রক্সি চেক, প্রজন্ম এক্স, কর্পূর, টাকার খেলা, ষোলো আনা প্রেম, নায়িকা, একা একা, আল্লাহ রাখলে মারে কে, যষ্টি মধু, বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, অফিসার্স রিটার্নস, টিকলী, এক পলকে দেখা, জান্নাত থেকে জান্নাত, স্বজনহারা, আমরাও মানুষ, ভালোবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে, মন আমার মন, প্রেমের অধিকার, দিঘি, প্রিয়া শুধু আমার, অফিসার, রঙিন পৃথিবী, তুমি কী আমার ভালোবাসা, জটিল বন্ধন, কানামাছি, শতরূপে শতবার, সবকিছু  পেছনে ফেলে, নীল মেঘ, অন্যরকম প্রেমকাহিনী, পায়রা মহুয়া, আউলা মন, আদি, মায়া, রাঙামন, গ্রেফতার, এবার তো হবে প্রেম, মিলন সেতু, নাকফুল, মনের মাঝে ভালোবাসা, তোকে বউ বানাব, তোমার প্রেমে পড়েছি, সমসাময়িক, অনেক দৃষ্টি কেড়ে তুমি এলে, অসম প্রেম, কাটপিস, অচেনা পৃথিবী, ভালোবাসা ২৪+৭, এক কোটি টাকা, আমার শূন্য হৃদয়, অন্তঃসত্ত্বা ইত্যাদি। এমন ছবির সংখ্যা আরও প্রায় অর্ধশতাধিক হবে। দিন দিন এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের কাছে কেন ছবির কাজ শুরু হচ্ছে না জানতে চাইলে তারা প্রযোজকের নানা সমস্যার কথা বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন। চলচ্চিত্র পরিচালক মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, নামসর্বস্ব অনেক পরিচালক প্রযোজকের টাকা খসানোর জন্য অনেক সময় মন্ত্রীও এনে মহরত করে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে প্রযোজককে প্রলুব্ধ কপ্রণ। এরা হচ্ছেন মহরত ডাইরেক্টর। এমন অসাধু লোকের জন্য সত্যিকারের প্রযোজকের মনে চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্মায় এবং লগ্নিকারক পাওয়া যায় না। এদের হাত থেকে চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতেই হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন বলেন, একটি প্রবাদ আছে- ‘খালি কলস বাজে বেশি’। যারা মহরতেই ছবি শেষ করে তাদের অবশ্যই অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে। মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে যে কোনো ফায়দা লুটে। চলচ্চিত্রশিল্পের অবস্থা নামধারী এই নির্মাতারাই খারাপ করছেন। প্রযোজককে নানা লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছেন। ফলে ছবি নির্মাণে আর এগিয়ে আসেন না প্রযোজকরা। চলচ্চিত্রকে পুঁজি করে এমন নেতিবাচক কাজ করা মোটেও উচিত নয়। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাব মিলনায়তনে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে প্রধান অতিথি করে মহরত করা হয় অচেনা পৃথিবী ছবির। পরিচালক সালমান বিন আকরাম। ওই ছবির শুটিং শুরু না করেই ঠিক চার মাসের মাথায় ওই বছরের ২৬ আগস্ট ওই পরিচালক ‘রাজ-দ্য নিউ সুলতান’ নামে আরেকটি ছবির মহরত করেন। এর একটিরও পরবর্তীতে আর কোনো খবর মেলেনি। ‘চাঁদনী’ ছবির মহরত করেন পরিচালক শামিমুল ইসলাম। এফডিসিতে রকিবুল আলম ‘প্রেমিক’ ছবির মহরত করেন ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট। ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ‘প্রতিশোধ’ ও ‘প্রতীক্ষা’ নামে একসঙ্গে দুটি ছবির মহরত করেন মুস্তাফিজুর রহমান। একই পরিচালকের ‘হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসা’ ছবির মহরত হয় ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালক সুমন দে ‘বাপের দোয়া কি কম দামি?’ নামে একটি ছবির ঘোষণা দেন। সাফিউদ্দিন সাফির পরিচালনায় ‘রাজকুমার’ চলচ্চিত্রের মহরত হয় ২০১৬ সালের ২৯ মে এফডিসিতে। ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই এফডিসিতে মহরত হয় রফিক শিকদার পরিচালিত ‘আমি শুধু তোর হব’ চলচ্চিত্রটির। শাহানূর রিপন শুরু করেন ‘প্রাচীর পেরিয়ে’ ছবির কাজ। ২০১৬ সালে আবদুল মান্নান মহরত করেন ‘প্রেমের অনেক জ্বালা’ ছবির। ‘দোস্ত দুশমন’ ছবির মহরত করেন পরিচালক বি কে আজাদ। ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি এফডিসিতে ‘মা’ ছবির শুটিং করেন কালাম কায়সার। ২০১৬ সালের ৯ মে মগবাজারের শ্রুতি স্টুডিওতে ‘কলঙ্ক’ ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয়। ছবির পরিচালক এম এ আউয়াল পিন্টু। ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বুলবুল বিশ্বাস পপিকে নিয়ে ঘোষণা দেন ‘কাটপিস’-ছবির। ২০১৬ সালে মাসুম পারভেজ রুবেল এফডিসিতে মহরত করেন ‘মিশন সিক্স’ ছবির। লেনিন হায়দার ‘মিশন সিআইডি’র মহরত করেছিলেন ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর। ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে মহরত হয় সেলিম রেজা পরিচালিত ‘না বলা ভালোবাসা’র। সাদ্দাম হোসেনের ‘বিয়ে হলো বাসর হলো না’, ‘মন খোঁজে বন্ধন’ নামের ছবির ২০১২ সালে মহরত হলেও এসব ছবির মধ্যে একটিও এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি বলে জানায় প্রযোজক সমিতি। ছবিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেই ছিল নতুন নায়িকা। সেই নায়িকাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা শুধু অনুমান করা যায়, বাস্তবে তাকে আর রুপালি পর্দায় দেখা যায় না,  এমন উদ্বেগ চলচ্চিত্রবোদ্ধা অনুপম হায়াতের।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর