শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

মঞ্চনাটকে অবহেলিত ‘একুশ’

মোস্তফা মতিহার

মঞ্চনাটকে অবহেলিত ‘একুশ’

কবর নাটকের একটি দৃশ্য

দেশের যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম ও ক্রান্তিকালে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে নাটকের রয়েছে অনন্য ভূমিকা। সংলাপের সঙ্গে সুর, সেই সঙ্গে এক্সপ্রেশনের মিশেলে নাটকের মঞ্চে শিল্পীরা নান্দনিক প্রতিবাদে ফুঁসে উঠতেন। মুক্তির লড়াইয়ে রণাঙ্গনের যোদ্ধার মতো আর গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য রাজপথের সাহসী যুবকের মতো মুক্তিযুদ্ধ থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে মঞ্চ থেকেই প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠত অধিকার আদায়ের স্লোগান। তবে, অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় মুক্তির প্রেরণার উজ্জীবনী শক্তি একুশকে নিয়ে মঞ্চে খুব একটা নাটক হয়নি। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রে একুশের চেতনা শাণিত হলেও মঞ্চ এখনো একুশকে ভালোভাবে ধারণ করতে পারেনি। যার প্রমাণ মঞ্চনাটকে একুশের ঋদ্ধতার অনুপস্থিতি। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর আলোচিত ‘কবর’ নাটকটি ছাড়া মঞ্চের আঙিনায় একুশের প্রভাব একেবারেই নেই। ১৯৭২ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভাষার মাসের প্রথম দিন দেশের শীর্ষস্থানীয় নাট্যদল আরণ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে নাটকটি মঞ্চায়ন করে। ওই সময় নাটকটি দেশের নাট্যাঙ্গনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর আলোচিত ‘কবর’ নাটকটি ছাড়া ভাষা আন্দোলন তথা একুশ নিয়ে মঞ্চে খুব একটা নাটক নেই। এর আগে ১৯৫৩ সালে কারাবন্দীরাই নাটকটিতে প্রথম অভিনয় করেছিলেন। শহীদ দিবস পালনের উদ্দেশে প্রগতিবাদী রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে একুশের প্রেক্ষাপটে ১৯৫৩ সালে ‘কবর’ নাটকটি রচনা করেছিলেন মুনীর চৌধুরী। ১৯৫১ সালে আসকার ইবনে শাইখ একুশে নিয়ে লিখেছিলেন ‘দুর্যোগ’ নাটকটি। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৯৫৪ সালে তিনি রচনা করেন নাটক ‘যাত্রী’।

এ ছাড়া একুশের চেতনা ও ভাষাশহীদদের স্মরণে কাইজার আহমেদের ‘বায়ান্নের শকুন’, রেজ্জাকুল হায়দারের ‘হরমুজ আলীর একুশ, আলী আনোয়ারের ‘বোবা মিনার’, রফিউল কাদের রুবেলের ‘ভাষা বদল’, ‘একুশের ইতিবৃত্ত’ উল্লেখযোগ্য। আর মিলন চৌধুরীর পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুনের দিনে’ নাটকে মাতৃভাষার মর্যাদা ও ভাষাশহীদদের তুলে ধরা হলেও ভাষা আন্দোলনের ৬৯ বছরে তা একেবারেই যৎসামান্য। থিয়েটারের মমতাজ উদ্দীন আহমদের ‘বর্ণচোরা’ নাটকটিতেও ছিল একুশের ছায়া ও প্রেক্ষাপট। আর নাগরিক নাট্যাঙ্গন একুশ নিয়ে মঞ্চায়ন করে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘আমাদের জন্ম হলো’ নাটকটি। হাতে গোনা এই কয়েকটি নাটক ছাড়া মঞ্চে একুশের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। এ নিয়ে নাট্যাঙ্গনের মানুষের মাঝেও রয়েছে আক্ষেপ। বলা চলে মঞ্চনাটকের মানুষদের দ্বারা বাঙালির ভাষা আন্দোলন তথা একুশ দারুণভাবে অবহেলিত। নাটকের গর্বিত ইতিহাসের অঙ্গনে একুশের অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে জ্যোৎ¯œালোকিত গগন অমানিশার তমস্যার মতোই।

বিষয়টি নিয়ে নাট্যকার, বরেণ্য অভিনেতা ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ বলেন, নাট্যকর্মীরা সব আন্দোলন-সংগ্রাম ও দেশের ক্রান্তিকালে যে ধরনের ভূমিকা রেখেছেন সেই ধারাবাহিকতায় একুশ নিয়ে সেরকম নাটক হয়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকটির মধ্য দিয়ে আমরা মঞ্চে একুশের চেতনাকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আরণ্যকের এই নাটকটি নাট্যানুরাগী ও নাটকের মানুষ দ্বারা ব্যাপক সমাদৃত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় এরপর একুশ নিয়ে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে নাটক খুব একটা হয়নি। এতে আমি নিজেও ক্ষুব্ধ। একুশ নিয়ে আমাদের আরও অনেক বেশি কাজ করার দরকার ছিল।

নাট্যাভিনেতা ও নির্দেশক লাকী ইনাম বলেন, সৈয়দ শামসুল হক রচিত ‘আমাদের জন্ম হলো’ নাটকটি মঞ্চায়নের মাধ্যমে একুশের চেতনাকে শাণিত করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করেছি। নাটকটি অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। দেশে অনেক নাটকের দল আছে। সব দলই প্রায় ২০ থেকে ২৫টি নাটক প্রযোজনা করেছে। প্রত্যেক দল যদি একটি করেও একুশের নাটক মঞ্চায়ন করত তাহলে একুশ নিয়ে আমাদের নাটকের সংখ্যা অনেক বেশি হতো। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক যেভাবে আমরা করছি, আমাদের গর্বের, অহংকারের বিষয় একুশ নিয়েও সেভাবে নাটক করা উচিত। নাটকের দলগুলোকে আন্তরিক প্রচেষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে।

পাভেল রহমান বলেন, একুশ আমাদের অহংকারের জায়গা। কিন্তু আমাদের মঞ্চগুলোতে একুশ সেভাবে জায়গা করে নিতে পারেনি। আমি মনে করি, এটা আমাদের ব্যর্থতা। একুশের প্রেরণা থেকেই যে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের মঞ্চে একুশের অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে কষ্টের ব্যাপার। আমরা চাই মঞ্চে বেশি বেশি একুশের নাটক হোক।

বাংলাদেশ থিয়েটারের অধিকর্তা নাট্যজন খন্দকার শাহ আলম বলেন, একুশের প্রেরণা থেকেই আমরা মুক্তির পথে এগিয়ে যাই। একুশের শাণিত চেতনাই আমাদের শক্তি।  একুশ নিয়ে প্রত্যেক দলেরই উচিত নাটক করা।

সর্বশেষ খবর