সোমবার, ১৪ জুন, ২০২১ ০০:০০ টা

সুস্থধারার সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত কেন

মুক্ত আকাশ সভ্যতার সুবাদে পশ্চিমা সংস্কৃতির আগমন এবং অনুকরণপ্রিয়তা বাঙালি সমাজ ব্যবস্থা ও সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। দেশীয় সংস্কৃতির মেলবন্ধনে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতির যে সৌন্দর্যবোধ ছিল তা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় যেমন ঘটছে তেমনি দেশের তরুণ সমাজও বিপথগামী হয়ে উঠছে। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সংস্কৃতি  ব্যক্তিত্বরা কে কী মনে করছেন তা তুলে ধরেছেন- আলী আফতাব ও পান্থ আফজাল

 

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু

আমাদের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র প্রত্যেকেরই একটি আলাদা সংস্কৃতি আছে। এ সংস্কৃতিতে ব্যক্তিরটা পরিবার গ্রহণ করে না, পরিবারেরটা সমাজ গ্রহণ করে না, আবার সমাজের সংস্কৃতি রাষ্ট্র গ্রহণ করে না। শুধু অর্থ হলেই সংস্কৃতির মান বৃদ্ধি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এখানে দুই ধরনের সংস্কৃতি। বস্তুগত ও চেতনাগত। চেতনাগত পরিবর্তনটাও প্রয়োজন।  আমরা সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রগুলো ক্রমেই হারাতে বসেছি। মাঠ, থিয়েটার, সিনেমা হল- এগুলো ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছি। নিজস্ব সংস্কৃতি হারিয়ে আজ পণ্য সভ্যতায় প্রবেশ করছি। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের সংস্কৃতিকে লালন করে উন্নতি ঘটাচ্ছে। কিন্তু আমরা তা পারছি না।

 

রামেন্দু মজুমদার

সুস্থধারার সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে কয়েকটি কারণে। প্রথমত মিডিয়ার কারণে। এরপর সস্তা জনপ্রিয়তার কারণে আর কিছু বিনিয়োগকারীর জন্য, যারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন এখন। এসব বিনিয়োগকারী তাদের মতো করে সবকিছু করতে চান। আসলে মানুষ যদি চায়, তাহলে তো সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা সম্ভব; না চাইলে নয়। সর্বোপরি এ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রয়োজন। সুস্থধারার সংস্কৃতিচর্চায় সরকারি বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নেওয়া দরকার। ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতাও দরকার। বিভিন্ন রকম ভালো উদ্যোগই পারে সুস্থধারার সংস্কৃতিকে বেগবান করতে।

 

গাজী মাজহারুল আনোয়ার

সুস্থধারার সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো পারিপার্শ্বিকতা ঠিক করা। আমরা যদি বলি, আমাদের দেশে গানের কোনো পরিবেশ নেই, চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিবেশ নেই, ভালো সংস্কৃতি নেই। এসব বললে হবে না। যুদ্ধের সময় যেসব গান তৈরি করেছি, যেসব সিনেমা নির্মাণ হয়েছে, তখন কি পরিবেশ ভালো ছিল? যুদ্ধের সময় আমাদের রাইফেলে যে কয়টা গুলি ছিল তার চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাস ছিল আমাদের মনে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে মন্দ লোকের সংখ্যা কিন্তু বেশি না। আমাদের যদি সঠিক শিক্ষা থাকে, নিজের প্রতি নিজের আত্মবিশ্বাস থাকে তবে এই অপসংস্কৃতি আমাদের কিছুই করতে পারবে না।

 

ববিতা

যেখানে মানুষ এখন ঘরবন্দী, কিছুই করতে পারছে না, সেখানে সুস্থধারার সংস্কৃতি আর অসুস্থধারার সংস্কৃতি কী। আর অসুস্থধারা সংস্কৃতির প্রবেশ আমাদের দেশে নতুন কিছু না। আমার ঘরের কাজের লোকটিও আমাদের দেশের নাটক-সিনেমা দেখে না। তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলে, আমাদের এসব নাটক দেখতে ভালো লাগে না। আমাদের হিন্দি সিরিয়াল দেখতে ভালো লাগে। এই যে বিদেশি নাটক আমাদের দেশে অবাধে প্রবেশ করছে, কারও যেন কিছু বলার নেই। এসব বিষয়ে আমাদের বলে কিছু হবে না। যারা আইন প্রণয়ন করেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করব, তারা যেন এ বিষয়গুলো মাথায় রাখেন।

 

মামুনুর রশীদ

সংস্কৃতি মানে কিন্তু নাচ, গান নয়; এটি আমাদের সম্পূর্ণ জীবনাচরণ। এর মধ্যে রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থাও জড়িত। একজন পরিপূর্ণ মানুষের জন্য দরকার সঠিক ও পরিশুদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা। সেই অবস্থা কী এখন আছে? সঠিক কোনো শিক্ষাব্যবস্থা এখন নেই, মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। ইয়াং জেনারেশনের ৯৪% এখন মিথ্যাচার করছে, দুর্নীতি করছে, টাকা মেরে দিচ্ছে, অস¦াভাবিক ও অসুস্থ জীবনযাপন করছে। আমাদের আগের সেই মূল সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। শুদ্ধ জীবন যাপন আমরা কবেই হারিয়ে বসেছি। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজ কীভাবে শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা করবে? মিডিয়াও হয়ে গেছে ভাগাড়।  তো এমন করে কি সুস্থধারার সংস্কৃতি টিকে থাকবে?

 

দিলারা জামান

সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা তো কমে গেছে। সংস্কৃতির মধ্যে অপসংস্কৃতি ঢুকে গেছে। ফলে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যদি নাটক ইন্ডাস্ট্রির কথা বলি, তবে বলব তাড়াহুড়ো করে একগাদা নাটক নির্মাণ হচ্ছে এখন। অভিনয় না শিখে আসা কিছু শিল্পীকে নাটকে যুক্ত করা হচ্ছে। অশ্লীল ভাষা ও অঙ্গভঙ্গির নাটক নির্মাণ হচ্ছে। ভাষাকে বিকৃত করে আজগুবি ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে। ভালো কনটেন্ট নেই। একই রকম রোমান্টিক গল্প। কাজ করা হচ্ছে দায়সারাভাবে। ফলে ভালো নাটক দর্শক দেখতে পারছে না। জনপ্রিয়তা ভিউ দিয়ে কাউন্ট হয়! নির্মাতারা দিন দিন সিনিয়র চরিত্র কাটছাঁট করছেন। আর এসব কিছু নির্দিষ্ট বিনিয়োগকারীরা নিয়ন্ত্রণ করছেন।

 

আবুল হায়াত

সংস্কৃতি এখন আর মানুষের হাতে নেই। এটা চলে গেছে বেনিয়াদের হাতে। তারা ব্যবসায়ী চিন্তাভাবনা আর স্বার্থসিদ্ধি উদ্ধারে সর্বত্র সংস্কৃতির ওপর লাঠি ঘোরাচ্ছে। তারা যা দেখাতে চায়, তাই তো এখন দেখছে সবাই! মাঝে তো অশ্লীলতা ঢুকে গিয়ে মিডিয়া নষ্ট হয়ে গিয়েছিল; এখন কিছুটা হলেও কমেছে। আসলে সুস্থধারার সংস্কৃতি বিনির্মাণে এখন কারও কোনো চেষ্টা নেই। কারও সময় নেই এসব নিয়ে ভাবার। চলচ্চিত্র ও টিভি মিডিয়া তো বেনিয়াদের হাতে পুরোপুরি চলে গেছে। তবে আশার কথা, থিয়েটার অঙ্গন এখনো সুস্থ আছে। এখানে এখনো নিয়মিত শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা হয়, ভালো স্ক্রিপ্টে কাজ হচ্ছে। মঞ্চ আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছে।

 

সাবিনা ইয়াসমিন

 আমাদের দেশটা সংস্কৃতির ভান্ডার। তবে এখানে যে অপসংস্কৃতির প্রবেশ, তা নতুন নয়। করোনার এই সময়টাতে আমরা ঘরবন্দী।   নেই স্টেজ শো, নেই নতুন গান তৈরি করার সেই তাড়া। এই সময়টাতে যে যার মতো  ঘরে বসে ইউটিউবে যা ইচ্ছা তা করে যাচ্ছে। জনপ্রিয় আর সুন্দর সুন্দর গানগুলোকে নষ্ট করার কোনো অধিকার তাদের নেয়। রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়ার এক নেশায় মেতেছে কিছু শিল্পী। এটা আমাদের জন্য অনেক কষ্টের। আরও কষ্টের বিষয় হচ্ছে এসব দেখার মতো যেন আমাদের কেউ নেই। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের এই গানের ভান্ডার কাদের হাতে তুলে দিয়ে যাব। এসব অপসংস্কৃতি আমাদের রুখতে হবে।

সর্বশেষ খবর