জামদানি শাড়ি দিয়েছিলাম
সুজাতা
হঠাৎ করেই খবরটা শুনলাম। বিশ্বাস করতে পারিনি। কেঁদেই ফেললাম। সুচিত্রা সেনকে ঘিরে আমার খুব আনন্দের স্মৃতি আছে। স্বাধীনতার পরপর সে ঘটনা। আমি আর আমার স্বামী আজিম সুচিত্রা সেনকে দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমার বাচ্চার জন্য আমি সে সময় যেতে পারিনি। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন আমার স্বামী এবং প্রয়াত অভিনেতা হাসমত। তারা দুজন সুচিত্রার বাসায় পৌঁছানোর আধাঘণ্টা পর দোতলা ঘরের সিঁড়ি থেকে কালো একটি শাড়ি পরে সুচিত্রা সেন নেমে আসেন। কুশলাদী বিনিময় শেষে যখন আজিম সুচিত্রা সেনকে আমার পাঠানো মেরুণ রঙের শাড়িটি উপহার হিসেবে তার হাতে তুলে দেন তখন তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কে দিয়েছেন? জবাবে আজিম বলেছিলেন 'এই শাড়ি আপনার ছোট বোন সুজাতা আপনাকে ভালোবেসে উপহার হিসেবে দিয়েছেন।' সুচিত্রা সেন শাড়িটি হাতে নিয়ে অনেকটা সময় দেখে বলেন, যদি কোনোদিন বাংলাদেশে আবার যাই, তবে আমার বোনের সঙ্গে দেখা হবে। না আর দেখা হলো না। প্রিয় সেই মানুষটি চলেই গেলেন।
তিনি বেঁচে থাকবেন
রাজ্জাক
সুচিত্রা সেন আর নেই। নিজের অভিনীত ছবির মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি উত্তম-সুচিত্রার ভীষণ ভক্ত ছিলাম। সুচিত্রা সেনের বসু পরিবার ছবিটি আমি জীবনে প্রথম দেখি। শুধু সুচিত্রা সেনই নয়, উত্তম কুমারের ভীষণ ভক্ত ছিলাম আমি। ছাত্রাবস্থায় আমি তাদের দুজনের ছবি পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। যখন টুকটাক অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত হলাম তখন উত্তম কুমারেরই ভাই তরুণ কুমারও অভিনয় করতেন। তার সঙ্গে সখ্যর কারণে এক দিন উত্তম-সুচিত্রাকে দেখতে শুটিংয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে দূর থেকে সুচিত্রা সেনকে এক ঝলক দেখেছিলাম। সেই স্মৃতি আজ সত্যিই চোখে বার বার ভেসে উঠছে। সুচিত্রা সেন যে চিরায়ত রূপ আমাদের সামনে রেখে গেছেন সেই রূপ নিয়ে আমাদের চোখের সামনেই তিনি বেঁচে থাকবেন অমর হয়ে। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে পৃথিবীর বুকে তিনি একটি ইতিহাস রচনা করে গেলেন। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জড়িত থেকেও তিনি নিজেকে বহু বছর লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখেই চলে গেলেন। এটা যে কত বড় সেক্রিফাইজ তা বলে বুঝানো যাবে না।
সুচিত্রা দিদির সঙ্গে কিছুক্ষণ
সুচন্দা
১৯৭২ সালের শেষের দিকের ঘটনা। একটি কারণে কলকাতায় গিয়েছিলাম। সেখানে গেলে আমার মায়ের কাছের মানুষ অভিনেত্রী বনানী চৌধুরীর বাসায় উঠতাম। এক দিন সেখানে ফোন করেছিলেন জহির রায়হানের বন্ধু রামু। কলকাতায়ই থাকতেন তিনি। ফোনে তিনি জানান বিকালে তৈরি হয়ে থাকতে। আমাকে নিয়ে এক জায়গায় যাবেন। আমাকে নিয়ে তিনি একটি বাড়িতে গেলেন। সোফায় বসে ছিলাম। হঠাৎ সামনে কাউকে দেখতে পেয়ে চমকে গেলাম। আমি কী স্বপ্ন দেখছি, নাকি সত্যি! যার অভিনয় নকল করার চেষ্টা করেছি সেই মহানায়িকা সুচিত্রা সেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে! তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন। আমার সামনে চলে এলেন। একটুও অহঙ্কার নেই, নেই কোনো দম্ভ। আমার কাঁধে হাত রাখলেন, কুশলাদি জানতে চাইলেন। আমি সব প্রশ্নের উত্তর একবাক্যে বলার পর বললাম, 'আপনার জন্যই আজ আমি সুচন্দা হয়েছি।' তিনি সেটি মানতে চাইলেন না! আমাকে বোঝালেন, তোমার মেধার কারণেই তুমি সুচন্দা। তোমার যোগ্যতা ছিল। হয়তো তোমার চলার পথে আমি অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করেছি। হয়তো আমাকে দেখে তুমি ইচ্ছাশক্তি বাড়িয়েছ। এক্ষেত্রে কৃতিত্ব তোমারই।'
অনেকক্ষণ কেটে গেল। বিদায় নেওয়ার সময় আমার পাশে এসে বসলেন সুচিত্রা। আবার আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, 'যখনই তোমার মন খারাপ হবে, আমার কাছে চলে আসবে। আমি তোমার দিদি...। আর আমিও যদি কোনো দিন দেশে যাই, তাহলে তোমার বাড়িতেই উঠব।' এই হলো আমার সুচিত্রা-দর্শন। এই আমার বিশ্বজয়।
আজ স্মৃতিগুলো ভেসে আসছে বার বার। তিনি নেই এ কথা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে খুব।