বাংলাদেশে বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ঘিরে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের একাধিক ক্রেডিট কার্ড গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে হঠাৎ টাকা উধাও হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে তীব্র সমালোচনা চলছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) শেয়ার না করলেও তাদের কার্ড থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে, অথচ ব্যাংক দায় স্বীকার করছে না। সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটেছে গত ২৬ আগস্ট। ভুক্তভোগী হাসিন হায়দার তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে লিখেছেন, আমার স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ভিসা কার্ড থেকে হঠাৎ ৫০ হাজার টাকা বিকাশ অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। ফোনে ওটিপি এলেও আমি তা কারও সঙ্গে শেয়ার করিনি। মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই লেনদেন সম্পন্ন হয়ে যায়। অথচ ব্যাংক বলছে, যেহেতু ওটিপি ব্যবহার হয়েছে, তাই এটা গ্রাহকের দায়।
তার অভিযোগ, ঘটনার পরপরই ব্যাংকের হেল্পলাইনে যোগাযোগ করতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। এক এজেন্ট প্রথমে অভিযোগ নিতে অস্বীকৃতি জানান, পরে আরেকজন কেস নম্বর দেন। এতেই বোঝা যায় ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিস কতটা অসংগঠিত, লিখেছেন হাসিন।
পাঁচ দিন পর ব্যাংক থেকে জানানো হয়, যেহেতু ওটিপি ব্যবহার হয়েছে, তাই এটিকে জালিয়াতি ধরা হবে না। কিন্তু ভুক্তভোগীর দাবি, তিনি কোনোভাবেই ওটিপি শেয়ার করেননি। তার মতে, এটি ব্যাংকের সাইবার নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে ঘটেছে। শুধু হাসিন হায়দার নন, আরও অনেক গ্রাহক একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। সাদিয়া শারমিন বৃষ্টি বলেন, সাত বছর ধরে কার্ড ব্যবহার করলেও প্রথমবার জালিয়াতির শিকার হয়েছেন। তার কার্ড থেকেও ৫০ হাজার টাকা নগদে ট্রান্সফার হয়েছে। মেহেদী হাসান বলেন, ৩০ আগস্ট তার কার্ড থেকেও ৫০ হাজার টাকা উধাও হয়। অভিযোগ করলেও ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের কিছু করার নেই। ফারিহা কবির বলেন, ২৯ আগস্ট তার কার্ড থেকে অননুমোদিতভাবে টাকা কেটে নেওয়া হয়। তিনি জানান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও নগদ উভয়েই দায় এড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘেঁটে দেখা গেছে, অন্তত ১০০ জনের বেশি গ্রাহক একই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টাড ব্যাংকের কাস্টমার সার্ভিস যথাযথ সহায়তা করেনি। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ নিতেই দেরি করা হয়েছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বলছে, ওটিপি ভেরিফায়েড লেনদেন হওয়ায় এগুলোকে প্রতারণা ধরা হবে না। ফলে ব্যাংক গ্রাহকদের ওপরই দায় চাপাচ্ছে। তবে ৫ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের হেড অব রিটেইল ব্রাঞ্চেস ভুক্তভোগী হাসিন হায়দারকে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং জানিয়েছেন, বিকাশ ও নগদসহ অংশীদারদের নিয়ে নতুন তদন্ত শুরু হবে।
ব্যাংকিং ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব ঘটনা নিছক জালিয়াতি নয়। ওটিপি ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হওয়া মানে গ্রাহকের তথ্য সিস্টেম পর্যায়ে ফাঁস হয়েছে। এটি অভ্যন্তরীণ অসৎ কর্মী বা ব্যাংকের নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে ঘটতে পারে। তাদের পরামর্শ বাংলাদেশ ব্যাংকের জরুরি ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। প্রমাণিত হলে ব্যাংককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের সচেতন থাকতে হবে এবং অনলাইন লেনদেনের অ্যাকাউন্টে অতিরিক্ত টাকা না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ব্যাংক অভিযোগ পেয়েছে এবং তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান। তিনি বলেন, জালিয়াত চক্র সবসময় সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। তাই গ্রাহকদের সতর্ক থাকতে হবে এবং ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা আরও জোরদার করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নিরাপদ ও বিশ্বস্ত ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এ ঘটনাগুলো গ্রাহকদের আস্থায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘যদি বৈশ্বিক ব্যাংকেই নিরাপদ না থাকি, তাহলে টাকা রাখব কোথায়?’ এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাসের এজাজ বিজয়কে কল করা হলেও তিনি ধরেননি। পরে হোয়াটস অ্যাপে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি উত্তর দেননি। এ বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের হেড অব ওয়েলথ অ্যান্ড রিটেইল ব্যাংকিং লুথফুল হাবিব বলেন, গ্রাহকের আস্থা ও আর্থিক নিরাপত্তা রক্ষা করা তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ব্যাংকের প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অভিযোগ করা লেনদেনগুলো বহিরাগত সিস্টেম থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং তা ওয়ান-টাইম পাসওয়ার্ড (ওটিপি) যাচাইয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের নিজস্ব সিস্টেম, যেমন- ইন্টারনেট ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম ও নিরাপত্তা প্রটোকল কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।