প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ শুধু কলমের জাদুকর ছিলেন না। তিনি ছিলেন শিল্পী তৈরির দক্ষ কারিগর। তার কলমের ছোঁয়ায় প্রতিটি শব্দ যেমন জীবন্ত হয়ে উঠত তেমনি নির্দেশনা বা তার সাহিত্যের চরিত্রে শিল্পীর অভিনয়ে ঘটত প্রাণের সঞ্চার। হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করে অনেক আনকোরা শিল্পী পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। চিরদিনের জন্য বনে গেছেন সুপার স্টার।
আশির দশকে নির্মিত 'প্রথম প্রহর' ছিল হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম টিভি নাটক। একই দশকে 'এইসব দিনরাত্রি' তার প্রথম ধারাবাহিক নাটক। অন্যদিকে 'আগুনের পরশমণি' তার প্রথম চলচ্চিত্র। ক্যারিয়ারে অগণিত নাটক এবং ৮টি চলচ্চিত্রে তিনি অসংখ্য অভিনয় শিল্পী তৈরি করে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদ রচিত প্রথম টিভি নাটক 'প্রথম প্রহরে'র কয়েকটি সংলাপে মাত্র দেড় মিনিটের একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। এরপর 'এইসব দিনরাত্রি' ধারাবাহিকে হুমায়ূন আহমেদ নূরকে রফিক চরিত্রে কাস্ট করেন। এতেই অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের উত্থান ঘটল। 'কোথাও কেউ নেই'র বাকের ভাই, 'অয়োময়ে'র মীর্জা সাহেব, 'মাটির পিঞ্জিরা'র নান্দাইলের ইউনূস, 'শঙ্খনীল কারাগারে'র কলেজপড়ুয়া বেকার যুবক, 'আগুনের পরশমণি'র মুক্তিযোদ্ধা নূর, 'চন্দ্রকথা'র দাম্ভিক জমিদার চরিত্রগুলো আসাদুজ্জামান নূরকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে যায়। 'একদিন হঠাৎ' নাটকে কঙ্কাল বয়ে বেড়ানো লজিং মাস্টার, 'কোথাও কেউ নেই' নাটকে উকিল, 'সবুজ সাথী' নাটকে ঘোড়ায় চড়া ভিক্ষুক চরিত্র। হুমায়ূন আহমেদের নাটক বা ছবি মানেই হুমায়ূন ফরীদির স্বল্প অথচ সরব উপস্থিতি। 'শ্যামল ছায়া' ছবিতে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার অভিনয় ছিল আলাদা করে ভাবার মতো। প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের হুমায়ূন আহমেদের 'এইসব দিনরাত্রি'তে সুখী নীলগঞ্জ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে মাস্টারের ভূমিকায় অভিনয় সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এই নাটকে আবুল খায়েরের চরিত্রের নাম ছিল 'সুখী নীলগঞ্জ মামা'। প্রথমদিকে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও পরে দর্শকপ্রিয়তায় হুমায়ূন আহমেদ চরিত্রটির পরিধি বাড়িয়ে দেন। এরপর 'বহুব্রীহি'র দাদা, 'আজ রবিবারে'র বাবা, 'পিতৃত্বে' র গ্রাম্য পিতা চরিত্রে অভিনয় করে আবুল খায়ের দর্শক হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন।
'একদিন হঠাৎ' ও 'বহুব্রীহি' নাটকে পাগলাটে মামার চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় 'মামা'য় পরিণত হয়েছেন আলী যাকের। 'আজ রবিবার' ধারাবাহিকেও আলী যাকেরের অভিনয় দর্শক হৃদয়ে গেঁথে আছে।
প্রয়াত মোজাম্মেল হকের কাশি শুনেই হুমায়ূন আহমেদ তাকে পছন্দ করে ফেলেন। মোজাম্মেল হকের এই কাশি 'অয়োময়' নাটকে সুপারহিট হয়ে যায়। 'অয়োময়ে' ছোট মীর্জার লাঠিয়াল হানিফের চরিত্রের মধ্য দিয়েই ছোটপর্দায় মোজাম্মেল হকের আসন পোক্ত হয়ে যায়। 'কোথাও কেউ নেই' নাটকে সুবর্ণা মুস্তাফার মোনা চরিত্রে অভিনয় দর্শক হৃদয়ে চিরদিনের জন্য জ্বলজ্বলে হয়ে আছে। বাকের ভাই'র ফাঁসির পর এ নাটকের শেষ দৃশ্যে সুবর্ণা মুস্তাফার দূর অজানার পথে একাকী প্রস্থান সবার চোখে এখনো অশ্রুঝরায়। সারা যাকের টিভি দর্শকদের কাছে পরিচিতি পান 'অয়োময়' নাটকে ছোট মীর্জার বড় বউ চরিত্রে অভিনয় করে। হুমায়ূন আহমেদের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র মিসির আলি। 'অন্যভুবন' নাটকে আবুল হায়াত মিসির আলী চরিত্রে অভিনয় করেন। এখনো মিসির আলির কথা মনে হলেই সবার আগে ভেসে ওঠে আবুল হায়াতের অবয়ব। 'অয়োময়' নাটকে ছোট মীর্জার শালির চরিত্রে বিপাশা প্রথম সুযোগ পান। এ একটি নাটকই বিপাশাকে জনপ্রিয় অভিনেত্রীর প্লাটফর্মে দাঁড় করিয়ে দেয়। হুমায়ূন আহমেদের অনেক নাটকেই অভিনয় করেন বিপাশা। এরপর হুমায়ূনের 'আগুনের পরশমণি' ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করে বিপাশা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও লাভ করেন। ধারাবাহিক নাটক 'আজ রবিবার'এ চশমা পরা আহ্লাদি কণ্ঠে কথা বলা আনিসের চরিত্রে অভিনয় করে জাহিদ হাসান জনপ্রিয় হন। এরপর 'সবুজ সাথী' নাটকে লাঠিধরা পাগলা মফিজ, 'শ্রাবণ মেঘের দিনে' ছবিতে মতি, 'আমার আছে জল' ছবিতে জামিলসহ হুমায়ূন আহমেদের অসংখ্য মজার চরিত্রে অভিনয় করে জাহিদ আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষে। 'কোথাও কেউ নেই'তে মতি চরিত্রের মাধ্যমে অভিনয়ে যুক্ত হন মাহফুজ আহমেদ। প্রথম নাটকেই বিশাল পরিচিতি পান তিনি। এরপর চলচ্চিত্র 'শ্রাবণ মেঘের দিনে' সুরুজ আর 'দুই দুয়ারী'তে অভিনয় করে মাহফুজ জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পেঁৗছে যান।
হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য বা তার নির্দেশনায় কাজ করা মানেই নিজেকে তারকার আসনে সমাসীন করা। বহু তারকার জন্ম হয়েছে এভাবে। তিনি নিজ হাতে গড়েছেন অনেক অভিনয় শিল্পীকে। হুমায়ূন আহমেদের জাদুকরি হাতের ছোঁয়ায় যারা তারকা খ্যাতিতে শোবিজ আকাশে চির অক্ষয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে অন্যতম আরও কজন হলেন মমতাজউদ্দীন আহমেদ, রিয়াজ, ডলি জহুর, দিলারা জামান, মাহমুদা খাতুন, আবদুল কাদের, সালেহ আহমেদ, ফারুক আহমেদ, মেহের আফরোজ শাওন, ডা. এজাজুল ইসলাম, চ্যালেঞ্জার, মনিরা মিঠু, আফজাল শরীফ, স্বাধীন খসরু, শিলা আহমেদ, মামুন প্রমুখ।