আনিসুল হকের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়লো জাফর ইকবালের কথা। আমি তখন সবে ইস্কুল মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে, সম্ভবত ইলেভেন টুয়েলভের মাঝামাঝি একটা সময়ে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তখন চন্দনা চাকমা। ক্লাস নাইন থেকেই ও আমার বন্ধু। অসাধারণ রূপবতী, বুদ্ধিমতী, প্রতিভাময়ী এক মেয়ে। আমরা দুজনই আমাদের শৈশব থেকেই বইপোকা আর সিনেমাপোকা। আমাদের কলেজটা ছিল মেয়েদের কলেজ। কলেজে রেবেল বলতে ইন্টেলেকচুূয়াল বলতে আমরা দুজনই। চন্দনার লেখার হাত ছিল অসাধারণ। লিটল ম্যাগাজিনগুলোয় আমরা তখন কবিতা লিখছি, গল্প লিখছি। আমাদের লেখাগুলো তখন আগুনের মতো। জাতীয় পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেও লেখা ছাপা হয়ে যাচ্ছে। সিনেমা পত্রিকাতেও লিখছি, তখন চিত্রালী, সিনেমা, পূর্বাণী ভীষণ জনপ্রিয়। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন আর পত্রমিতালীর যুগ তখন। সাংঘাতিক সাংঘাতিক ব্যাক্তিগত বিজ্ঞাপনও আমরা মাঝে মাঝে দিচ্ছি। প্রচুর চিঠি আসে ডাকে। মানুষ পত্রমিতালি করতে চায়। বেছে বেছে ভালো ক'জনের সঙ্গে চলতেও থাকে পত্রমিতালি।
এমন সময় একদিন জাফর ইকবালের চিঠি আসে। চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল। অসম্ভব সুদর্শন এক নায়ক। আমার সঙ্গে পত্রমিতালি করতে আগ্রহী । আমি তো খুশিতে নাচছি। খুব সুন্দর নীল প্যাডে জাফর ইকবাল লিখতো। আমার বাড়িতে একদিন একটা লোক পাঠিয়েছিল জাফর ইকবাল, আমাকে ওর কিছু ছবি আর চিঠি দিতে। আমার কাছ থেকেও খুব চেয়ে টেয়ে আমার একটা ছবি নিয়ে গিয়েছিল। জাফর ইকবাল আমাকে ফোনও করতো। ফোনে যা কথা বলার সে-ই বলত, আমি শুধু হ্যাঁ হুঁ করতাম। আমাদের ফোনটা তখন বাবার ঘরে সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ড্রয়ারের মধ্যে বাবা তালা দিয়ে রাখতো। আমার ছোটদার দুষ্টুবুদ্ধি ছিল খুব। বাবা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে টেবিলেটার ওপর ভাগটা সরিয়ে ড্রয়ারের ভেতর থেকে ফোন বের করে ছোটদা গীতা মিত্রকে ফোন করতো। আর ওই পদ্ধতিতে আমার কাছে আসা জাফর ইকবালের ফোন ধরতাম আমি। একসময় হয়তো ফোনের বিল পেয়ে বাবা বুঝতে পারে সামথিং ইজ রং। তখন ফোনের লাইনটাই কেটে দিয়েছিলো। জাফর ইকবালের চিঠি এলে চন্দনাকে পড়াতাম। চন্দনাকে একদিন জাফর ইকবালের ঠিকানা দিয়ে বললাম লিখতে। আমি যখন জাফরে নিমগ্ন, চন্দনাও জাফরে নিমগ্ন। উঁচু উঁচু হিল জুতো কিনে, সেই জুতোর হিলে জাফরের ছবি লাগিয়ে রাস্তায় হাঁটতো চন্দনা। চন্দনাকেও লিখতে শুরু করে জাফর ইকবাল। ওর প্রতিটি চিঠিই চন্দনা আমাকে দেখাতো।
একদিন আমার ছোটদা চিপাচস নামের একটা দল থেকে জাফর ইকবালকে ময়মনসিংহে আমন্ত্রণ জানায়। জাফর ইকবাল চিপাচসের অনুষ্ঠান শেষে আমার আর চন্দনার সঙ্গে দেখা করার জন্য উতলা হয়ে উঠেছিল। আমার কী হয়েছিল কে জানে, আমি দেখা করতে চাইনি। সম্ভবত নিজের রূপ নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিলাম। আর তাছাড়া সিনেমার নায়কের সঙ্গে দেখা করেছি, বাবা জানতে পারলে পায়ের টেংরি ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবে। সিনেমার পত্রিকাগুলো বাবাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তে হতো। বাবা যে পত্রিকাটা আমার জন্য বরাদ্দ করেছিল, সেটার নাম ছিল 'বেগম'। জাফর ইকবাল অগত্যা সেদিন চন্দনার সঙ্গে দেখা করতে যায়। আহা আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া। সারাবিকেল সে কাটায় চন্দনাদের বাড়িতে। চন্দনা আমার চেয়েও বেশি ডাকাবুকো ছিলো, কিন্তু ছিলো আমার মতোই লাজুক। পরের কয়েকদিন তো আমাদের গেছে জাফর ইকবাল কী করেছে, কী বলেছে, কী খেয়েছে এসব নিয়ে. এরপর চন্দনার প্রেমে জাফর উন্মাদ হয়ে উঠলো। চন্দনাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু ও কিছুতেই বিয়ে করবে না। আমরা, আমি আর চন্দনা, আমাদের ষোলো বছর বয়সেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলাম, জীবনে বিয়ে টিয়ে করবো না। চন্দনার বাবা একসময় ময়মনসিংহ থেকে বদলি হয়ে গেলো কুমিল্লায়। কুমিল্লা থেকে একসময় চন্দনা চলে গেলো চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে পড়তে। আমি ভর্তি হয়ে গেলাম ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে। একদিন পত্রিকার পাতায় দেখলাম জাফর ইকবাল একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে। মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্কটা খুব দীর্ঘদিন ওর ভালো যায়নি। তারপর একদিন তো সেই দুর্ঘটনা ঘটে, জাফর ইকবাল মারা যায়। অনেকে বলে অতিরিক্ত মদ খাওয়ার ফলে অমন হয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমা জগতের সবচেয়ে ইয়ং সুদর্শন প্রতিভাবান রোমান্টিক নায়ক চুপচাপ চলে গেল। জানি না চন্দনা কোথায় ছিল তখন। আমার বুকের ভেতর জাফর ইকবালকে হারানোর কষ্টটা অনেক বছর ছিল।
( ফেসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)