২ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০৮:৩৯

একজন রাজীব এর জীবনী (১০)

দেবী গাফফার

একজন রাজীব এর জীবনী (১০)

অভিনেতা রাজীব ও দেবী গাফ্ফার

তিন বাচ্চা দুমকি রেখে রওয়ানা দিতে হলো জব্বার সাহেবের সংসারে। সতীন সতীনের বাচ্চা মিলিয়ে বিশাল সংসার। সারাদিন কাজ আর কাজ। ওই বাড়িতেই জন্ম হলো রাজীব সাহেব এর। দুধের শিশু কোলে নিয়ে সময়মত কাজ শেষ করতে পারেন না। লাঞ্চনা গঞ্জনার শেষ রইল না। ছোট্ট রাজীব হামাগুড়ি দিতে শিখে। হামাগুড়ি দিয়ে আগুনে হাত দেয়, গোয়াল ঘরে ঢোকে গোবরে মাখামাখি। এক পর্যায়ে ছোট্ট রাজীবকে খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে কাজ করতে হয়।

একরাতে সবাই খেতে বসে। অবুঝ শিশু রাজীব ভাতের প্লেটে হিসি করে দেয়। ছেলে বাচ্চা হিসি করলে ভাতের পাতে যাবেই। এতবড় অপরাধ ক্ষমা করা যায় না। সৎ ভাইয়েরা মেরে মেরে হিসি মাখানো ভাত রাজীব সাহেব কে খাওয়ালো। এই দুঃখ মা সহ্য করতে না পেরে ভোরে উঠে কাওকে কিছু না বলে দুমকি রওয়ানা দিলেন। তারপরের ঘটনা রাস্তায় রাজীব সাহেবকে কুড়িয়ে পাওয়া। আত্মহত্যা করতে পারলেন না,বাচ্চা ফেলে দিয়ে নিজেকে ক্ষমা ও করতে পারলেন না। ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারালেন। কয়েক বছর পর যখন সুস্থ হলেন, খবর পেলেন কাসেম সাহেব এর বাড়ীতে উনার সন্তান। সন্তান এর মর্যাদা পেয়েছেন।

সন্ধ্যার অন্ধকারে চুপিচুপি গাবতলী গ্রামে রওয়ানা দিলেন, হারানো সন্তানকে একনজর দেখার আশায়। দিনের বেলা গেলে মানুষ দেখলে চিনে ফেলবে। ঠিকই মা হালিমার চোখে পড়ে গেলেন। শুরু হলো চেচাঁমেচি। মা হালিমার ভয় যদি বাচ্চা নিয়ে যায়? উনি বাঁচবেন কি নিয়ে। তারপর থেকে শুরু হলো স্কুলের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা। এক নজর দেখার আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকা। ভোরবেলা গল্প শেষ হলো।

আমার কাঁন্না থামে না। আহারে মা, আমিও একজন মা। সেদিন থেকে টাকা কাপড় সব আমি পাঠাই। আর আমি রাজীব সাহেব কে বুঝাতে থাকি। মা তো মা-ই হয়। কোন অবস্থাতেই মার ওপর রাগ করতে হয় না। এক পর্যায়ে রাগ নেমে ভালোবাসায় পরিণত হয়। আমরা আগামী সপ্তাহ দুমকি যাবো, ঠিক হলো। আমি মা ছেলের মিলন দেখবো। আজন্মের রাগ অভিমান এর অবসান হবে।

যাওয়ার আগের দিন খবর আসে দুঃখিনী মা আর পৃথিবীতে নেই। আমার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে না। রাজীব সাহেব ও মা'কে জড়িয়ে ধরে বলতে পারলেন না "মাগো এইতো আমি।" পরবর্তীতে আমি মা লালমুন এর ছেলে মেয়েদের খবর দিই। বাসায় এনে ভাই বোন তাদের ছেলে-মেয়েদের একসাথে করি। রাজীব সাহেব খুশি হন। ওরা যার যার জায়গায় সবাই সম্মানের পেশায় নিয়োজিত। কেও ডাক্তার, কেও মাস্টার। মা লালমুন একাই জীবনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, আর কেউ হারেননি।

আমরা দুমকি গিয়ে মার কবর জিয়ারত করি। মার খালি রুমটাতে বসে থেকে একরাশ হাহাকার নিয়ে ঢাকা ফেরত আসার পথে বরিশাল লঞ্চ ঘাটে একলোক এসে বলে, স্যার আপনাকে জব্বার সাহেব একটু ডাকছেন। রাজীব সাহেব বুঝতে পারেন ইনিই সেই বাবা। আমারও বুঝতে বাকি রইলো না। দুই মিনিট পরেই ফিরে এলেন। কি হলো দেখা হয়েছে? কি কথা হলো? এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে?

খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললেন, জব্বার সাহেব বলছেন, উনি আমার বাবা। আমিও বলে এসেছি, আপনার ভুল হচ্ছে আমার বাবার নাম আবুল কাসেম। জব্বার সাহেবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেবিনে ঢুকে পড়লেন।

একসময় সেই সৎ ভাই, ভাই এর ছেলে লিটন লালমাটিয়ার বাসায় সাহায্য চাইতে আসে। যারা শিশু রাজীবকে এত মেরেছিলো যার বর্ননা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তাদের বড়ই করুণ অবস্থা। ভাত জুটে না। কাজ নাই। রাজীব সাহেব নিরবে তাদের কথা শুনে ভিতরে এসে আমাকে বললেন, দেখতো ওরা কি চায়? সমাধান করে বিদায় দাও। তাদের খাইয়ে টাকা পয়সা দিয়ে বিদায় দিলাম। মা'কে হারানোর ব্যথা রাজীব সাহেব এর অন্তরে আজীবন হাহাকার হয়ে বিরাজ করতো।

মানুষটা অনেক কম কথা বলেন, একটু ভীতু টাইপ। বুঝে উঠতে পারি না, এই মানুষটাই ক্যামেরার সামনে দাঁড়ালে অন্য মানুষ। হাজারো মানুষের সামনে বক্তৃতা করেন মাথা উঁচু করে। যখন বক্তব্য রাখা শুরু করেন এ যেনো অন্য মানুষ। যে মানুষটা সমাজের এত অনাদরে বেড়ে ওঠলো, তাঁর চিন্তা ধারা এত সুক্ষ হয় কেমন করে। শুনেন বেশি, বলেন কম। আর আমি সম্পূর্ন উল্টা। অনেক কথা বলি, যা মনে আসে বলতে থাকি।

রাজীব সাহেব অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে 'হাঙর নদী গ্রেনেড', 'প্রেম পিয়াসী', 'সত্যের মৃত্যু নেই', 'স্বপ্নের পৃথিবী', 'আজকের সন্ত্রাসী', 'দুর্জয়', 'দেনমোহর', 'স্বপ্নের ঠিকানা', 'মহামিলন', 'বাবার আদেশ', 'বিক্ষোভ', 'অন্তরে অন্তরে', 'ডন', 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত', 'ভাত দে', 'অনন্ত ভালোবাসা', 'রাজা শিকদার' ও 'বুকের ভেতর আগুন', 'সাহসী মানুষ চাই', 'বিদ্রোহ চারিদিকে', 'দাঙ্গা' প্রভৃতি।

রাজীব সাহেব শ্রেষ্ট পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন চারবার- হীরামতি (১৯৮৮), দাঙ্গা (১৯৯১), বিদ্রোহ চারিদিকে (২০০০) ও সাহসী মানুষ চাই (২০০৩)।

চলবে...

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর