কম্বোডিয়ার গহীন জঙ্গলের মাঝে সন্ধান পাওয়া গেছে হারিয়ে যাওয়া এক শহরের। দেশটির ইতিহাসে প্রাচীন এই শহরটির কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তা ছিল কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ছিল অনেক তর্ক-বিতর্ক। কিন্তু সব তর্ক-বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে শেষমেষ আবিস্কৃত হলো মধ্যযুগীয় এই শহরটির। সম্প্রতি একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ কম্বোডিয়ার জঙ্গলে বেশ কয়েকটি মন্দির, প্রশস্ত সড়ক এবং প্রকৌশল বিদ্যার নির্দশন আবিস্কার করেছেন।
১৯৫৮ সালে হেনরি মুহুত নামের এক ফরাসি ভ্রমনকারী লন্ডন থেকে দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার দিকে জাহাজে করে রওনা দেন। পরবর্তী তিন বছর তিনি এশিয়ার বিভিন্ন গহীন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। আজকের দুনিয়ার অনেকেই তার নাম ভুলে গেছেন কিন্তু তার লিখিত জার্নাল এখনও অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদকে অন্ধকারের মাঝেও আলোর দিশারি দেখায়। মুহুত মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এশিয়ার কালা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে লাওসে মারা যান।
মুহুতের জার্নালে পাওয়া যায়, ‘এখানে একটি জঙ্গল ঘুরে দেখলাম। এখানে এমন কয়েকটি মন্দির দেখলাম এবং সেই মন্দিরের গায়ে কিছু কাজ দেখলাম। মনে হলো কাজগুলো কোনো প্রাচীন মাইকেলঅ্যাঞ্জেলোর করা কাজ। গ্রীস এবং রোমের মন্দিরগুলোর চেয়ে অনেক বড় এই মন্দিরগুলো। মনে হয় একটা সময় এই জায়গায় অনেক সম্মানিত মানুষেরা চলাফেরা করতেন।’
মুহুতের ওই জার্নালের বক্তব্যগুলোকে দীর্ঘসময় স্রেফ ফ্যান্টাসি হিসেবেই দেখা হতো। কিন্তু মুহুত যে ভুল ছিলেন না তার প্রমাণ কম্বোডিয়ার অ্যাঙ্কর ওয়াত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে ধরা হয় একে। কারণ এই মন্দিরটি পুরো ভ্যাটিকান সিটির চেয়েও চারগুন বড়। প্রতিবছর এখানে প্রায় দুই মিলিয়ন পর্যটক আসে, যা কম্বোডিয়ার জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৮৬০ সালের আগে অ্যাঙ্কর মন্দিরের কথা কম্বোডিয়ার কিছু সন্ন্যাসী ছাড়া বাইরের বিশ্বের মানুষ জানতো না বললেই চলে। শুধু তাই নয়, এই মন্দিরটিকে কেন্দ্র করে যে বিশাল এক নগরসভ্যতা গড়ে উঠেছিল তাই এতোদিন মানুষ জানতো না। তবে মন্দিরটি আবিস্কৃত হওয়ার পর একদল প্রত্নতত্ত্ববিদ দীর্ঘদিন ধরেই পুরো মন্দির এবং শহরটিকে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গত বছর প্রত্নতত্ত্ববিদরা অ্যাঙ্কর মন্দির থেকে কিছু দূরে জঙ্গলের মাঝে একটি প্রাচীন শহরের সন্ধান পান। প্রথমে শহরটিকে পৃথক ভাবা হলেও এখন প্রত্নতাত্ত্বিকেরা দাবি করছেন যে ওই শহরটিও অ্যাঙ্কর মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
ইউনিভার্সিটি অব সিডনির একদল গবেষকের নেতৃত্বে আছেন ড. দামিয়ান ইভান্স। তার মতে, পুরো এলাকাটির আয়তন ৩৭০ বর্গকিলোমিটার। তবে এর আয়তন আরো বেশি হতে পারে। কিন্তু গত গৃহযুদ্ধের সময় পুরো জঙ্গল জুরে যে ল্যান্ড মাইন বসানো হয়েছে তা এখনও অক্ষত আছে। যার কারণে ইচ্ছে থাকা স্বত্ত্বেও জঙ্গলের গহীনে খননকার্য চালানো সম্ভব হচ্ছে না।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মন্দিরটির প্রথম তলায় পুরো একটি শহরের নকশা পেয়েছেন। যে নকশায় মন্দির, মহাসড়ক, ঝর্ণাসহ ইত্যাদি স্থাপত্যকলার নিদর্শন পাওয়া যায়।
ইভান্সের মতে, ‘প্রযুক্তির সাহায্যে যখন আমরা পুরো নকশাটি সম্পূর্ণ করি, তখন আমাদের মনে হয়েছিল যে আমরা একটা বিশাল কিছু আবিস্কার করেছি। আমরা বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না যে এতো প্রাচীন একটি শহর আমাদের হাতের নাগালে আছে।’
অ্যাঙ্কর ছিল কম্বোডিয়ার খামের সাম্রাজ্যের রাজধানী। কয়েক শতক ধরেই এই সাম্রাজ্যটি বিভিন্ন যুদ্ধবাজ নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রাচীন কম্বোডিয়ার আয়তন ছিল অনেক বড়। যা থেকে বর্তমানে ভিয়েতনাম, লাওস, থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারের সৃষ্টি। ধারণা করা হয়, নবম শতকে কম্বোডিয়ার রাজা জয়বর্মন দ্বিতীয় এই রাজধানীর পত্তন করেন। কিন্তু তারপরেও এখনও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা নিশ্চিত নন ঠিক কতটা প্রাচীন এই নগরসভ্যতা। হয়তো এর ইতিহাস অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে না জানা ইতিহাস অধ্যয়ের দরজা খুলে যাবে বিশ্ববাসীর জন্য।