১৭ জুলাই, ২০২১ ১৫:০৮

ব্যতিক্রমী স্বপ্নেই সাবলম্বী মাদরাসাছাত্র আরিফুল

মশিউর রহমান মাসুম, মোরেলগঞ্জ

ব্যতিক্রমী স্বপ্নেই সাবলম্বী মাদরাসাছাত্র আরিফুল

আরিফুল ইসলাম খান

মাঠে-ঘাটে পিতার বিরামহীন পরিশ্রম। মায়ের মলিন মুখ। বোনের নতুন জামার আবদার অপূর্ণ থাকা ও ছোট ভাইয়ের কর্মমুখী হওয়ার দৃশ্য দেখে এক সময় ব্যাতিক্রম কিছু করার চিন্তা করেন আরিফুল। নিজ গ্রামে সবাই যা কিছু করছে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু করে দেখাতে চাই। অপরকে চাকুরি দিব। পরিবারের সকলকে নিয়ে ভালো থাকবো। এমন নানা চিন্তায় একদিন বাড়ি ছাড়েন বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার গড়ঘাটা গ্রামের দরিদ্র কৃষক মোকছেদ আলী খানের ছেলে আরিফুল ইসলাম খান (২৭)।

প্রথমেই পার্শ্ববর্তী কচুয়া উপজেলায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নেন জমি পরিমাপের ওপর। কাজ শেখার পরে দেখলেন আয়ের চেয়ে দুর্নাম ও  সমালোচনা বেশি। ছুটলেন ভিন্ন দিকে। প্রথমে বাগেরহাটের যাত্রাপুরে মৌমাছি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে, পরে পিরোজপুর ও খুলনাতে প্রশিক্ষণ নিলেন মৌ চাষের ওপর। এর পরে স্বেচ্ছাশ্রমে হাতে কলমে শিক্ষা নেন কচুয়া উপজেলার সেকান্দার আলী পাইকের মৌমাছি খামারে। সেখানে ২ মাস প্রশিক্ষণের পরে আশার সঞ্চার হয় আরিফুলের মনে। কিন্তু টাকা? কমপক্ষে দুই লাখ টাকার দরকার মৌমাছির চাষ করে মৌ উৎপাদনে।

৫ ভাই-বোনের মধ্যে আরিফুল বড়। পরিবারের কারো সঙ্গতি নেই নগদ টাকা দেওয়ার। খুঁজে পেলেন দুই ভাইয়ের নামে থাকা .৭৮ শতাংশ জমির দলিল। ওই দলিল বন্দক রেখে দুই লাখ টাকা ঋণ নিলেন কর্মসংস্থান ব্যাংক, মোরেলগঞ্জ শাখা থেকে। নিবন্ধন নিলেন বিসিক থেকে। এবার ছোট ভাই ও দু’জন কর্মচারী নিয়ে ছুটলেন মৌমাছির সন্ধানে।

২০১৮ সালের নভেম্বর মাস তখন। গেলেন জামালপুরের মৌচাষী ওমর ফারুকের খাছে। ১ লাখ ৪৯ হাজার টাকায় নিলেন ৩০টি বক্স। প্রতিটি বক্সে একটি করে ‘এপিস মেলিফের’ জাতের রানী মৌমাছি ও প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক মৌমাছি রয়েছে। বক্সগুলো নিয়ে জামালপুর, শেরপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঠাকুরগাঁও, নাটোর ও দাকোপে সরিষা, ধনিয়া, কালোজিরা, লিচু ও তরমুজের বাগানের পাশে তাবু খাঁটিয়ে মৌমাছি ছেড়ে মধু সংগ্রহ করে টানা ৪ মাস পরে বাড়ি ফিরলেন আরিফুল। এ সময়ে তিনি সংগ্রহ করেছেন ১৪ মণ মধু। পরিশ্রমে চেহারার পরিবর্তন হলেও আনন্দটা ছিলো বিদেশফেরতের মতই।

আরিফুলের মৌমাছির খামারে এখন তার ছোট ভাই অলিদ খানও কাজ করেন। থাকা খাওয়া বাদ দিয়ে তার আয় আপাতত বছরে ১ লাখ টাকা। মৌসুম শুরু হলে অপর শ্রমিকদের বেতন মাসে ৮ হাজার টাকা করে। তার খামারে এখন বক্স হয়েছে ১১০টি। মৌসুম চলাকালীন (ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল) ৫ মাসে ৮০-৮৫ মণ মধু আহরণ করেন। বোতলজাত ও ড্রামে করে বিক্রি করছেন বিভিন্ন বাজারে। এর মধ্যে লিচুর মধু ১৬ হাজার, সরিষা ৮ হাজার, তরমুজের ১৩ হাজার ও কালোজিরার মধু প্রতি মণ ৩২-৩৫ হাজার টাকায় বিক্রয় করছেন। বর্তমানে খুলনায় তার গুদাম ঘরে দুই হাজার কেজি ও বাড়িতে প্রায় ৫০০ কেজি মধু মজুদ রয়েছে।

আরিফুল ইসলাম এ প্রতিনিধিকে বলেন, মধু প্রক্রিয়ায়াজাত করে বিক্রয় করতে পারলে দাম বেশি হবে। তাই, ইতোমধ্যে চীন থেকে একটি রিফাইনং মেশিন ক্রয়ের জন্য অনলাইনে চুক্তি করেছেন। মেশিনটির দাম পড়বে ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা। দেশীয় কর্তৃপক্ষ যদি ভ্যাট ও ট্যাক্স মওকুফ করেন তাহলে দাম পড়বে মাত্র আড়াই লাখ টাকা। মৌচাষ ৫ মাসের একটি মৌসুমী ব্যবসা। বছরের বাকি সময়টা কাজে লাগাতে একটি আধুনিক ধান কাটা ও মাড়াই মেশিন ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ৭০% ভর্তুকি মূল্যে যার দাম পড়বে প্রায় ১১ লাখ টাকা।

নিজের ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন বলতে আরিফুল বলেন, ‘ব্যতিক্রম কিছু করার স্বপ্ন এখন হাতের নাগালে। এখন আমি পর্যায়ক্রমে বিএসটিআই এর অনুমোদন নেব। বিসিক থেকে আরও একটি ট্রেড লাইসেন্স নিবো। নিজ বাড়িতে শিল্প কারখানা গড়ে তুলবো। মা-বাবাকে পরিশ্রম থেকে মুক্তি দেব। পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাবো। তবে, এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের সহযোগিতা আশা করছেন হতদরিদ্র পরিবারের আশার আলো, উদ্যমী যুবক আরিফুল।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সিফাত আল মারুফ বলেন, মৌমাছি ফসলের উৎপাদন বাড়ায়। কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে। তাই সফল মৌচাষী আরিফুলকে তেল ফসল উৎপাদন প্রকল্পের সভাপতি ও প্রশিক্ষক মনোনীত করা হয়েছে। 

বিডি প্রতিদিন/ফারজানা

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর