শনিবার, ১০ মে, ২০১৪ ০০:০০ টা
টয়োটা নকিয়া স্যামসাং সনি কোকাকোলা নেসলে

বিনিয়োগে প্রবল আগ্রহ নিয়ে এসে খালি হাতে ফেরত

স্মার্ট ফোন তৈরি করার জন্য খ্যাতনামা ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান স্যামসাং বাংলাদেশে কারখানা করার প্রস্তাব নিয়ে আসে ২০১২ সালের শেষে। এক বিলিয়ন ডলারের এ বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত লি ইয়ুন ইয়াং সরকারের প্রয়োজনীয় সব স্তরেই যোগাযোগ করেন। স্যামসাংয়ের প্রধান কার্যালয় থেকে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের প্রধান সরাসরি ফোন করে ঢাকায় বেপজার চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। ৫০ হাজার কর্মসংস্থানের এ কারখানা স্থাপনের জন্য আন্তরিকতার অভাব ছিল না স্যামসাং-এর। বার বার যোগাযোগ করা হয়। প্রথমে দুই হাজার একর জমি চাওয়া হলেও পরে ৫০০ প্লটের সমপরিমাণ জমির কথা বলা হয়। বেপজার পক্ষ থেকে তৎপরতা দেখানো হয়। কিন্তু চাহিদা মোতাবেক জমি পাওয়া যায়নি। কোরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প হিসেবে চট্টগ্রামের কোরিয়ান ইপিজেডের প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমোদন ও বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংযোগের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তাও হয়নি। ধাপে ধাপে অনুমোদনের জন্য স্যামস্যাং-এর হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয় রাষ্ট্রদূতকে। একাধিক ধাপের কর্মকর্তারা এ জন্য উৎকোচও দাবি করেন। প্রায় দেড় বছর ঝুলে থাকার পর স্যামসাং তার প্রস্তাবনা ফিরিয়ে নেয়। এখন মিয়ানমার হতে সেই কারখানা স্থাপনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়া চলছে। এক বৈঠকেই লোভনীয় এই প্রস্তাবের সব অনুমোদন দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।

প্রায় একই পরিস্থিতি আরেক বিশ্বসেরা ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি সনি করপোরেশনের। তারা টেলিভিশন তৈরির জন্য কারখানা স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছিল ২০১১ সালে। কিন্তু দুই বছর পরও তারা জমি পায়নি। বাংলাদেশ থেকে ফিরে গিয়ে সনি অবশ্য এরই মধ্যে কম্বোডিয়ায় তাদের কারখানা স্থাপন করে উৎপাদনও শুরু করে দিয়েছে। বরাবরই বাংলাদেশের উন্নয়নে আন্তরিকভাবে পাশে থাকা বন্ধু রাষ্ট্র জাপানের দূতাবাস এতে রীতিমতো অবাক হয়। কারণ বাংলাদেশে এযাবৎকালে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগের কারখানা স্থাপনের প্রস্তাব ছিল স্যামসাং ও সনিরই। কিন্তু কোম্পানি দুটোকে রীতিমতো খালি হাতে ফিরে যেতে হলো। বরং উল্টো সময়ক্ষেপণেরও শিকার হলো। একইভাবে জাপানের আরেকটি ইলেকট্রনিক্স কোম্পানি সুমিতমো কারখানার জন্য জায়গা চেয়েছিল। আগ্রহ দেখিয়েছিল মোটরগাড়ির কারখানা টয়োটাও। কিন্তু সরকার ইপিজেডের সম্প্রসারণ করতে চায়নি বলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে জায়গা দেওয়া সম্ভব হয়নি। একই পরিস্থিতি কোমল পানীয় প্রতিষ্ঠান কোকাকোলার। তারা গত ২০১০ সালে বাংলাদেশে প্লাট স্থাপনের প্রস্তাবনা নিয়ে আসে। ৫ কোটি ডলার বিনিয়োগের কারখানা স্থাপন করে ২০১৩ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরু করতে চেয়েছিল কোকাকোলা। সে জন্য বাংলাদেশের আগের ব্যবসায়িক অংশীদার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ এক কথায় দিয়ে দেয় কোকাকোলা। ভারতে থাকার আগের প্লান্ট বন্ধ করে দেওয়ায় দ্রুততা প্রয়োজন ছিল কোকাকোলার। কিন্তু সেই দ্রত সিদ্ধান্ত তো হয়ইনি, বরং উৎপাদন শুরুর যে প্রস্তাবিত তারিখ ছিল তার এক বছর পর পাওয়া যায় প্রাথমিক অনুমোদন। এখনো পুরোপুরি মেটেনি জমির সমস্যা। এখন ঢাকায় বিনিয়োগ না করে বিকল্প উপায়ে ব্যবসা করছে কোকাকোলা। প্লান্ট স্থাপনের জন্য আশপাশে বিকল্প দেশও খোঁজা হচ্ছে। প্রস্তাব এখনো তুলে না নিলেও উৎপাদন তারিখ পিছিয়ে গেছে দীর্ঘ সময়ের জন্য।

 

কোকাকোলা এখনো লেগে থাকলেও আরেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নেসলে তাদের কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে এসেও পিছিয়ে এসেছে। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশে নয়। একই পরিস্থিতি মার্কিন দুই বহুজাতিক বিনিয়োগকারী ডাবলিন গ্রুপ ও টাওয়ার করপোরেশনের। তারা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেও বাংলাদেশের পরিস্থিতি তাদের সেই আলোচনাতেই সীমিত রেখেছে।

হঠাৎ এত বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে কারখানা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠার কারণ কি শুধুই সস্তা শ্রম- জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক বিষয়াদির দেখভাল করা এক কর্মকর্তা জানান, মাল্টিন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে মহাগুরুত্ব বহন করা লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস গ্রুপের এফডিআই ম্যাগাজিনের জরিপে ২০১০ সালে মোট প্রকল্প ও বিদেশি বিনিয়োগ বিভাগে প্রবৃদ্ধির হারে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল। তখন বিশ্বের ৭০০ ইপিজেডের মধ্যে বাংলাদেশ একই সঙ্গে দুই খাতে সম্ভাবনাময় শীর্ষ তিনের মধ্যে স্থান করে নিয়েছিল। এ জন্যই মূলত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো।

তারপর কেন বিশাল বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়েও ফিরে গেল স্যামসাং, সনি, সুমিতমো, টয়োটারা এমন প্রশ্নের জবাবে কোরিয়া দূতাবাসের এক পদস্থ কূটনীতিকের খোলামেলা জবাব, একদম পাশাপাশি থাকা চট্টগ্রাম রপ্তানি উন্নয়ন অঞ্চলে (সিইপিজেড) সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ থাকছে, কিন্তু কোরিয়ান রপ্তানি উন্নয়ন অঞ্চলে (কেইপিজেড) বিদ্যুতই নেই। আবার মিয়ানমারে গেলে মন্ত্রী ও সরকারের প্রতিনিধিরা একবাক্যে নিশ্চয়তা দিচ্ছে সেখানে বিনিয়োগ করলে সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার। তাহলে স্যামসাং কেন এখান থেকে মিয়ানমারে যাবে না। বাংলাদেশে কোরিয়ান ইপিজেডের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ১৯৯৬ সালে কোরিয়ান ইপিজেড বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন করে। প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ১৯৯৯ সালের আগস্টে জমি পাওয়া যায়। কিন্তু ব্যবসা পরিচালনার জন্য অপারেশনাল লাইসেন্স পাওয়া যায় ২০০৭ সালে। পরিবেশ ছাড়পত্র পাওয়া যায় ২০০৯ সালে। পরে পরিবেশ অধিদফতর থেকে এই ছাড়পত্র বাতিল করা হয়। আবার মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলে তা ফিরে পাওয়া যায়। রেগুলেটরি অর্ডার বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাওয়া যায় ২০১০। কিন্তু অর্জিত জমির স্থানান্তর দলিল কার্যকর হয়নি। যে কারণে আইনগত বরাদ্দ না পাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে রাজি হচ্ছেন না। আবার ২ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগের ৩৩ কেভি পাওয়ার সাপ্লাই লাইন ও ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন স্থাপন করা হয়েছিল। যা ৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার সিকিউরিটি ডিপোজিটের মাধ্যমে সচল করা হয়েছিল। তাও অবৈধভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। অন্যদিকে জাপান দূতাবাসের অপর এক কূটনীতিক বললেন, বাংলাদেশে ইচ্ছা ও বাস্তবতার মধ্যে অনেক ব্যবধান। এখানে কোনো ভালো ইচ্ছা বাস্তবায়নেও পদে পদে বাধা আসে। তাই এখানে অনেক ইতিবাচক বিষয়ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। এই কূটনীতিক তার দেশে আয়োজিত এক মেলার অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, সেখানে বড় বড় সব বিনিয়োগকারীই ছিলেন। তারা কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারের বিষয়ে আগ্রহ দেখালেন। কিন্তু কেউই বাংলাদেশের কথা বললেন না। এটা দেশের নেতিবাচক ইমেজের কারণেই হয়েছে।

জাপান ও কোরিয়ার এই দুই কূটনীতিকের মতে, বাংলাদেশে সবার আগে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এখানকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বিদ্যুৎ-গ্যাসসহ ইউটিলিটি সমস্যা, জমির ক্ষেত্রে বাড়তি চার্জ আদায়, নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রানা প্লাজা ধসের মতো দুর্যোগ, প্রয়োজনীয় যোগাযোগ অবকাঠামো না থাকা, ঢাকা-সিউল সরাসরি বিমান ফ্লাইট না থাকা, ঢাকা-টোকিও ফ্লাইট স্বল্পতা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ বাধা। সেই সঙ্গে আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সঠিক সময়ে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সীমাবদ্ধতা।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর