বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৫ ০০:০০ টা

ঢাকার দুই সিটি ডোবাচ্ছে ওয়াসা

২৬ খালের ১৩টিই অকেজো দখল-দূষণে

লাকমিনা জেসমিন সোমা

একদিকে দখল ও দূষণ, অন্যদিকে পরিচর্যার অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে রাজধানীর বেশির ভাগ খাল। ওয়াসার দায়িত্বে থাকা এসব খালের প্রায় শতভাগই এখন অকেজো। অন্যদিকে খালগুলোতে সুষ্ঠু   পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করতে না পারায় ঢাকার জলাবদ্ধতা নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে দুই সিটি করপোরেশন। নগরীর উন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে কাজ শুরু হলেও এ জলাবদ্ধতা সংকট নিয়ে অসহায়ত্বের কথা বলছেন দুই মেয়র। এমনকি সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, আগামী বর্ষা মৌসুমে ঢাকা ডুবে গেলেও তাদের কিছু করার থাকবে না। এমন পরিস্থিতিতে খালগুলোর অবৈধ দখল, দূষণ ও বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। প্রতিবেদন অনুসারে ঢাকার ৪৩ খালের মধ্যে ২৬টিই ওয়াসার দায়িত্বে। সবচেয়ে ‘সমস্যাসংকুলের’ তালিকায় থাকা ১৩টি খালও ওয়াসার। সচিত্র প্রতিবেদনে এ ১৩টি খালের দখল, দূষণ ও বিভিন্ন সমস্যার বিষয়টি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ডিএনসিসি, যেখানে ওয়াসার শতভাগ গাফিলতির চিত্রই ফুটে উঠেছে। ২৯ নভেম্বর এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে ওই বিশেষ সচিত্র প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হয়। এ সময় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানায়, প্রতিবেদনটি উপস্থাপনের পর মন্ত্রী উপস্থিত ওয়াসা কর্মকর্তাদের ওপর অনেকটা খেপে যান। তাদের উদ্দেশে বলেন, আপনারা তো মনে হয় ওইসব এলাকায় কোনো দিন যাননি, সেখানকার ড্রেনগুলোও কখনো পরিষ্কার করেননি। ডিএনসিসির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ভাষায়, ‘প্রতিবেদন দেখে ওইদিন মন্ত্রী ওয়াসাকে বাংলাওয়াশ করেছেন।’ প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার মোট ৪৩টি খালের মধ্যে ২৬টিই ওয়াসার। অন্যদিকে মোট খালের অন্তত ২২টিই পড়েছে উত্তর সিটিতে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেহাল অবস্থায় রয়েছে ১৩টি, যার সব কটিই ওয়াসার। সমস্যাসংকুল এসব খালের মধ্যে রয়েছে একই নামে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে থাকা বাউনিয়া খাল, রূপনগর খাল, কালশী খাল, ক খাল, খ খাল, গ খাল, ঘ খাল, ঙ খাল, চ খাল (ওয়াসার দেওয়া নাম অনুসারে), রামচন্দ্রপুর খাল, কাটাসুর খাল, মুসলিমবাজার খাল, পাগলার পুল খালসহ আরও বেশ কয়েকটি খাল। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখল, দূষণ এবং ওয়াসার নিয়মিত পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ খালগুলো ড্রেনেজ সিস্টেমের কোনো কাজেই আসছে না। সচিত্র প্রতিবেদনে দেখা যায়, মিরপুর চিড়িয়াখানা রোড থেকে কমার্স কলেজের পেছন হয়ে পল্লবী পর্যন্ত ৬০ ফুট প্রশস্ত মিরপুর-রূপনগর খালটি ময়লা-আবর্জনা ও কচুরিপানায় ভরে গেছে। এ খালের সংযোগস্থলে ৫ ফুট ব্যাসের পাইপ বসিয়ে পুরো খালটি সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। একইভাবে তুরাগ নদ থেকে বাউনিয়া বাঁধ, পলাশনগর ও মেহেদীবাগ থেকে কালশী পর্যন্ত বিস্তৃত বাউনিয়া খালটি এখন প্রায় অকেজো। এ খালের বাউনিয়া বাঁধ এলাকায় অবৈধ দখল করে বালু ভরাট করা হয়েছে। মিরপুর মেহেদীবাগ এলাকার খালটিতে ওয়াসার গাফিলতি ও দখলবাজদের কারণে খোলা নর্দমার পরিবর্তে ৩ ফুট প্রশস্ত পাইপলাইন দ্বারা পানি প্রবাহিত হচ্ছে। মিরপুর-১১ অঞ্চলে সীমানাপ্রাচীর বানিয়ে এ বাউনিয়া খাল সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। ফলে মিরপুর-১১ অঞ্চলে সাংবাদিক কলোনি, পলাশনগর ও খালসংশ্লিষ্ট অন্য সব এলাকায় সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে। মিরপুর-১২-এর কালশী প্রধান সড়ক থেকে মিরপুর সিরামিক রোড পর্যন্ত মুসলিমবাজার খালটি এখন ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়। খালের গর্ভে ময়লার আস্তরণ জমে এমনই অবস্থা হয়েছে যে, কেউ ইচ্ছা করলেই এ খালটির ওপর দিয়ে পায়ে হেঁটে ওপার চলে যেতে পারবে। নাখালপাড়া পাগলার পুল খালটির অবস্থাও একই। বিভিন্ন বাড়িঘর ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দখলে চলে গেছে হাজারীবাগের কাটাসুর ও রায়েরবাজারের রামচন্দ্রপুর খাল দুটি। সেখানে পানি পর্যন্ত সিমেন্টেড হয়ে গেছে। এ ছাড়া অবৈধ দখল ও দূষণ থেকে রক্ষা করতে না পারায় ওয়াসার দায়িত্বে থাকা আগারগাঁও-কল্যাণপুরের ক খাল, মিরপুর মাজার রোডের খ খাল, পশ্চিম শেওড়াপাড়া থেকে পীরেরবাগ হয়ে পশ্চিম কাফরুল পর্যন্ত ঘ খাল, উত্তর কাফরুল পুরাতন বিমানবন্দর সীমানা থেকে ইব্রাহিমপুর হয়ে কচুক্ষেত প্রধান সড়ক মিলি সুপার মার্কেট পর্যন্ত ঙ খাল এবং আগারগাঁও পঙ্গু হাসপাতালসংলগ্ন কল্যাণপুর চ খালও মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে। কোথাও কাথাও ম্যানুয়াল মানচিত্রে খালকে রাস্তা হিসেবে দেখিয়ে রাজউক থেকে হাউজিং গড়ার অনুমোদন নিয়েছেন দখলবাজরা। এ প্রসঙ্গে গত সপ্তাহেই উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘মেয়র হিসেবে একটি বিষয়ে নগরবাসীকে আমি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না। আর তা হলো জলাবদ্ধতার সমস্যা।’ তিনি বলেন, ‘খালের অবৈধ দখলের মাধ্যমে ড্রেনেজ সিস্টেম ধ্বংস করা হয়েছে। কোথাও কোথাও ময়লা-আবর্জনা ফেলে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে ফেলা হয়েছে। বড় খালগুলো সিমেন্টেড হয়ে গেছে। এগুলো পরিচর্যার দায়িত্ব ওয়াসার। আমরা কয়েক দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ এমন ১৩টি খালের সচিত্র প্রতিবেদন এলজিআরডি মন্ত্রীকে দিয়েছি। বলেছি আপনারা দখলমুক্ত করে দিন, রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। কেননা, খালগুলোকে দখলমুক্ত করে এখনই যদি পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে আগামী বর্ষায় কী হবে বলতে পারছি না।’ এদিকে প্রতিবেদনে খালগুলো নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে এ মুহূর্তে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় প্রতিটি খালের প্রকৃত সীমানা চিহ্নিতকরণ, অবৈধ স্থাপনা থেকে খালগুলোকে দখলমুক্তকরণ, মূল প্রশস্ততায় খালগুলো পুনরায় খনন এবং নিয়মিত সেগুলোর ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার অপরিহার্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (সিভিল সার্কেল) শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা সরেজমিন গুরুত্বপূর্ণ ১৩টি খালের ছবি তুলে এনে মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে দেখিয়েছি। সমস্যা সমাধানে করণীয়গুলোও তুলে ধরেছি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে সম্ভবত একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটিও গঠন করেছেন মন্ত্রী। এখন দেখা যাক, কী হয়।’

সর্বশেষ খবর