শনিবার, ২১ মে, ২০১৬ ০০:০০ টা

আস্থা তৈরি করতে পারছে না ইসি

ইউপি ও পৌর নির্বাচনে শক্ত অবস্থান প্রমাণ করতে পারেনি ঘরে বাইরে প্রশ্ন, বিতর্কিতই মনে করছে বিরোধী দলগুলো

গোলাম রাব্বানী

প্রথমবারের মতো দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্র দখল, প্রকাশ্যে সিল মারা, জাল ভোট, ব্যালট ছিনতাইসহ নানা অনিয়মের ঘটনায় আস্থার সংকটে পড়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। কমিশনকে নিয়ে ঘরে-বাইরে রয়েছে নানা প্রশ্ন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল ইসির ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বিরোধী দলগুলো বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত হিসেবে আখ্যায়িত করছে। এমনকি আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো সংঘাতপূর্ণ ইউপি নির্বাচনে ইসির অবস্থান নিয়ে কঠোর সমালোচনা করছে। বিগত সংসদ, উপজেলা, সিটি নির্বাচন নিয়েও বর্তমান ইসি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। এবারের পৌর ও ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক সংঘাত-সহিংসতা-জাল ভোট, শতভাগ ভোট গ্রহণ ও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হওয়ায় সেই বিতর্ক আরও চরমে উঠেছে।

এবারের ইউপি নির্বাচনকে অনেকে রক্তস্নাত নির্বাচন বলছেন। নির্বাচনী সংঘাতে প্রায় ৯০ জনের বেশি মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। প্রাণ দিতে হয়েছে নারী, শিশু, হকার, মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও। এমন সহিংসতা ইসির দায়িত্বহীনতার কারণেই ঘটেছে বলে মনে করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে নির্বাচনী সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জনগণ ভোট ও ইসির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। এবার ইউপি ভোটে কেন্দ্র দখল, কারচুপি, জাল ভোট ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির পাশাপাশি প্রার্থীদের সমর্থকদের সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনাগুলো ঘটেছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউপি নির্বাচনের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে ইসি। তারা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। কেউ ইসির কথা শুনছে না। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, প্রশাসনের ওপর নির্বাচনী কাজ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তারা। তবে দলীয়ভাবে ইউপি ভোটে জালিয়াতি ও সহিংসতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। অবশ্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারও বলেছেন, দলীয় কোন্দলের জেরে এবং নির্বাচন নিয়ে এটা হয়ে থাকে। ইউপি নির্বাচন সব সময় ঝামেলাপূর্ণ। আগেও সহিংসতা হয়েছে। এটা এড়াতে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এবারে ছয় ধাপের ইউপি নির্বাচনের মধ্যে চার ধাপ শেষ হয়েছে। দলভিত্তিক এই ইউপি নির্বাচন ঘিরে অনিয়ম, কেন্দ্র দখল ও গোলযোগের ঘটনায় অন্তত ৯০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। অনিয়ম, ফল পুনর্গণনা, জাল ভোট ও ফল পরিবর্তনসহ নানা ধরনের অভিযোগ নিয়ে প্রার্থীরা ইসির দ্বারস্থ হচ্ছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে জাল ভোট, সিল মারা, ফলাফল পাল্টানোসহ নানা অনিয়মের হাজার হাজার অভিযোগ নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের টেবিলে টেবিলে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু হাতে গোনা দু-একটা ছাড়া অধিকাংশ অভিযোগ আমলে নিচ্ছে না নির্বাচন কমিশন। দিনের পর দিন ফাইলবন্দী থাকছে এসব অভিযোগ। এসব নিয়ে জনগণের মধ্যে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। আগামী দুই ধাপের নির্বাচনে পরিস্থিতি আরও অবনতি হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অনেকে। প্রার্থীরাও নানা হুমকি-ধমকির মধ্যে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা করছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী ও বিএনপির অনেক প্রার্থী এলাকাছাড়া হয়েছেন। এ ছাড়া দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করেও নির্বাচনী পরিবেশ-পরিস্থিতি শান্ত করতে পারছে না ইসি। প্রার্থীদের হাজার হাজার অভিযোগ থাকলেও তারা তা আমলে নিচ্ছে না। ডিসি, এসপি, রিটার্নিং অফিসার, ওসিরা ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণেই কাজ করছেন। ডিসি-এসপি ও মাঠপ্রশাসনের কর্মকর্তারা ইসির কোনো নির্দেশনাই মানছেন না। ফলাফল পাল্টানোসহ অস্বাভাবিক হারে ভোট পড়ারও অভিযোগ উঠছে। ইউপি নির্বাচনের এমন পরিস্থিতিতে ইসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মনে করছেন, মাঠপ্রশাসনের ওপর নির্বাচনের সব দায়িত্ব দিয়ে ইসি হাঁপ ছেড়ে বাঁচতে চাইছে। তাই তারা নির্বাচনী হাল ছেড়ে দিয়েছে। যে যেভাবে পারছে সিল মেরে নিচ্ছে। অনেক মাঠকর্মকর্তা ফলাফলও পাল্টে দিচ্ছেন। কিন্তু ইসি কিছুই বলছে না। অনেকে আক্ষেপ করে বলেন, কী দরকার টাকা দিয়ে ব্যালট ছাপানোর! চেয়ারম্যানদের বললেই তারা নিজেরদের প্রতীকে সিল দিয়ে ব্যালট ছাপিয়ে নিতেন! একজন নির্বাচন কমিশনার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তো আমাদের না। পুলিশ কথা না শুনলে আমাদের কী করার আছে।’ সম্প্রতি ইসিতে অভিযোগ জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বেসামরিক বিমান পরিবহন, পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। তিনি নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘আমরা একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছি। আপনারা সেই সংগ্রামের অর্জন। আপনারা ব্যর্থ হোন এটা আমরা চাই না। কিন্তু এই নির্বাচনে যা ঘটছে তা হলো ন্যক্কারজনক— ব্যালটে সিল মেরে বাক্সে ভরার মহোৎসব চলছে।’ এ বিষয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছেন, নির্বাচনের নামে সহিংসতা ও অনিয়ম চলতে পারে না। এ সহিংসতা বন্ধে ইসিকেই প্রধান উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, শৃঙ্খলার ভার পুলিশের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে তো হবে না। কন্ট্রোল করতে হবে। ইসির কথা তারা শুনছে কি না তাও জনগণকে বোঝাতে হবে। সহিংসতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সর্বশেষ খবর