বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০১৬ ০০:০০ টা

তারাবি

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

তারাবির নামাজ রোজা পালনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। হজরত হুরায়রা (রা.) বর্ণিত এবং বুখারি ও মুসলাম শরিফে বর্ণিত হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, যে ব্যক্তি রমজান মাসের রাত্রিতে ঈমান ও সতর্কতা সহকারে নামাজ আদায় করবে, তার পূর্বের যাবতীয় গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। এ হাদিসে কিয়ামে রমজান হিসেবে যে নামাজের উল্লেখ করা হয়েছে, হাদিস ব্যাখ্যাকারকগণ তাকে তারাবির নামাজ বলে শনাক্ত করেছেন। তারাবি তারাবিহাতুন শব্দের বহুবচন। তারাবিহাতুন এর অর্থ আরাম করা, বিশ্রাম করা। বিশেষ নামাজের নাম তারাবি রাখার কারণ এ নামাজ প্রতি চার রাকাত আদায়ের পর কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম করা বা বিশ্রাম দেওয়া হয়। আরবি ভাষাতত্ত্বে তারাবি শব্দের বুৎপত্তি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রতি চার রাকাত নামাজের পর বসে বিশ্রাম করা হয় এবং যে নামাজ এশার ফরজ ও সুন্নাতের পর এবং বিতরের নামাজের পূর্বে পড়া হয়। তারাবির নামাজ পাঠ সুন্নত। মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা রমজান মাসের রোজা থাকা ফরজ করেছেন আর আমি সুন্নাত রূপে চালু করেছি রমজান মাসব্যাপী আল্লাহর ইবাদতে দাঁড়ানো (বা তারাবির নামাজ)। মহানবী (সা.) তারাবির নামাজ পড়েছেন কিন্তু তা রীতিমতো প্রত্যেক রাতে পড়েননি। এর কারণ স্বরূপ তিনি নিজেই বলেছেন, রোজার রাতের এই তারাবির নামাজ তোমাদের প্রতি ফরজ হয়ে যাওয়ার ভয় করছি আমি। হাদিস বেত্তাগণের মতে, তারাবির নামাজ মুস্তাহাব, অর্থাৎ এ নামাজ ফরজ বা ওয়াজিব নয়।

তারাবির নামাজ জামাতে পড়া প্রসঙ্গে ফিকাহবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। তারাবির নামাজের রাকাত সংখ্যা বিভিন্ন হাদিসে বিভিন্ন রকমে উদ্ধৃত হয়েছে। যাহোক তারাবির নামাজ সিয়াম সাধনার একটি অন্যতম অঙ্গ। সিয়াম সাধনা একটি ট্রেনিংবিশেষ, যার মুখ্য উদ্দেশ্য রোজাদারের জীবনযাপনকে শৃঙ্খলামণ্ডিত করে তোলা। আরাম ও আয়েশ প্রবণতাকে সংযত করাও এ ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্য। জীবনে সংগ্রাম ও কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই। সারা দিন রোজা রাখার পর রাতে বিশ্রাম গ্রহণের অনিবার্য আকাঙ্ক্ষাকে অবদমিত করে তারাবির নামাজ পাঠ করা হয়— কঠোর কৃচ্ছ  সাধনের এটি একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রক্রিয়াও বটে। বিশ্রাম ও আরাম-আয়েশ প্রবণতাকে সচেতনভাবে হ্রাস করার মাধ্যমে একজন রোজাদার মুসলমান ব্যক্তিগত জীবনে কঠোর পরিশ্রমের দীক্ষা লাভ করতে পারে।

তারাবির নামাজ পাঠের মধ্যে রয়েছে আল্লাহর রাস্তায় চলার ক্ষেত্রে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে জীবনকে সুন্দর করার লক্ষ্যে কঠোর পরিশ্রমের অনুপ্রেরণা। আল্লাহর প্রকৃত বান্দা, সত্যের সৈনিক কখনো আরামপ্রিয় হতে পারে না। পরকালমুখিনতার কারণেও শুধু নয়, দুনিয়ামুখিনতার কারণেও আরামপ্রিয় হলে চলে না। জীবন সংগ্রামে কৃতকার্য হতে হলে অবশ্যই পরিশ্রমী হতে হয়। সুতরাং তারাবির নামাজে আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু শরিক হওয়া নয়, এ নামাজ আদায়ের মাধ্যমে আরামকে হারাম করে কঠোর পরিশ্রম করার দীপ্ত শপথের ও মানসিকতা অর্জনের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তারাবির নামাজে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে একাগ্রচিত্তে বিনীতভাবে আল্লাহর কালাম শ্রবণ করতে হয়। এভাবে এ নামাজ আরামকে হারাম করার মনোবল সৃষ্টিতে সহায়তা করার মাধ্যমেই এর কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে।

রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন— ‘আল্লাহতায়ালা রমজানের সিয়াম পালন করাকে ফরজ এবং রাতে তারাবি পড়াকে সুন্নাত সাব্যস্ত করেছেন। কোনো ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের নিমিত্তে রমজানে কোনো নফল আমল করলে সে রমজানের একটি ফরজ আদায় করার সমান সওয়াব লাভ করবে। আর রমজানে কোনো ফরজ আদায় করলে রমজানের বাইরে সত্তরটি ফরজ আদায়ের সমান সওয়াব লাভ করবে। বস্তুত রমজান হলো ধৈর্যের মাস এবং এ ধৈর্যের বিনিময় হচ্ছে জান্নাত। আর এ মাস মানুষের প্রতি সমবেদনা ও সহানুভূতি প্রকাশের মাস।’ লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।

সর্বশেষ খবর