মাহে রমজানের সিয়াম সাধনায় রোজাদারের জন্য আল্লাহরাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে পুরস্কার প্রদান প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘রোজা একান্তভাবে আমারই জন্য হয়ে থাকে। অতএব আমিই এর প্রতিফল দিব’ (হাদিসে কুদসি)। আল কোরআনের ষষ্ঠ সূরা আন-আম এর ১৬০ আয়াতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কেউ কোনো সৎকাজ করলে সে তার দশগুণ পাবে।’ সূরা বাকারার ২৪৫ আয়াতে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে— “যে লোক আল্লাহকে উত্তম ‘করজ’ দিবে, আল্লাহ প্রতিদানে তাকে তা বহুগুণ বেশি করে দিবেন।” মাহে রমজানে রোজা পালনকারীর ক্ষেত্রে আরও স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, যেহেতু রোজা তাঁরই (আল্লাহ) জন্য রাখা হয় সেহেতু তিনিই তাঁর প্রতিফল দেবেন। হাদিস বেত্তাগণ এই কুদসি হাদিসটির ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন, রোজার সওয়াব কত হবে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই তার পরিমাণ পরিমাপ করতে পারে না। এর কারণ রোজার এমন কতগুলো বিশেষত্ব রয়েছে, যা অন্য কোনো ইবাদতে পাওয়া যায় না। রোজার কোনো বাস্তব ও দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। অন্য ইবাদত যেমন— নামাজ, হজ, জাকাত ইত্যাদির বাহ্যিক দৃশ্যমান অবয়ব রয়েছে। রোজা হলো পানাহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা। এর পশ্চাতে অন্তর্নিহিত থাকে শুধু নিয়ত। নিয়ত একটি মানসিক প্রত্যয়- মানসিকতা মাত্র। এটি অন্য কেউ দেখতে পায় না। একজন রোজাদার প্রকৃতই রোজাদার কি-না তা অকাট্য ও অনস্বীকার্যভাবে কেউ বুঝতে বা ধরে দেখতে পারে না। একমাত্র আল্লাহরাব্বুল আলামিনই তা জানেন। তাই কুদসি হাদিসটির মর্মার্থ হতে পারে— কেউ প্রকৃত রোজা রেখেছে কিনা তা একমাত্র আল্লাহই জানতে পারেন। একমাত্র আল্লাহর জন্য রোজা রাখা হয়েছে কিনা তাও তিনি ছাড়া আর কারও পক্ষে জানা সম্ভব নয়। অতএব কার রোজার কি প্রতিফল হতে পারে তাও তিনি ছাড়া আর কেউ নির্ধারণ করতে পারেন না। এর প্রতিদান পুরস্কার আর কারও পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, আর কারও সাধ্যও নেই তা। অন্য একটি হাদিসে কুদসিতে আল্লাহরাব্বুল আলামিন বলেন, ‘রোজাদার আমারই কারণে, আমারই নির্দেশ পালনে ও আমারই সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে তার প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ ও পানাহার পরিহার করে বা বিরত থাকে। রোজা পালনে কৃচ্ছ সাধনা, প্রবৃত্তি দমন ও দৈহিক ব্যস্ততা মুখ্য, রোজা পালনে ব্যক্তিগত দৃঢ় প্রত্যয় একাগ্রচিত্ততা ও আত্মশুদ্ধির প্রয়াস মুখ্য। সুতরাং অন্য ইবাদত হতে রোজা পালনের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। আর আল্লাহর জন্যই এই অকৃত্রিম একনিষ্ঠতা, আন্তরিকতা ও ধৈর্যধারণ। মরহুম মাওলানা মুহম্মদ আবদুর রহীম (হাদিস শরিফ। দ্বিতীয় খণ্ড ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ) এই হাদিসের আরেকটি অর্থ নির্দেশ করেছেন, ‘এই রোজা একান্তভাবে আমারই (আল্লাহরাব্বুল আলামিন) জন্য রাখা হয়েছে। এতে অন্য কেউই আমার সঙ্গে শরিক নাই এবং রোজাদার রোজা রেখে আমার ছাড়া আর কারও ইবাদত করেনি। আর কারও সন্তুষ্টি লাভ তার লক্ষ্য নয়। আর কারও নিকট থেকে সে এর প্রতিফল পেতে চায়নি। কেননা অন্য যে সব ইবাদত দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়, তা মুশরিকরাও তাদের মাবুদের জন্য করে বা করতে পারে। কিন্তু রোজা সেরূপ নয়। বস্তুত কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ও তাঁর বিধানমতে রোজা রাখা হয়েছে কিনা তা সেই আল্লাহ ছাড়া আর কেউই জানতে পারে না। আল্লামা ইবনুল কায়িমের মতে, এটাই রোজার হাকিমত, রোজার মর্মকথা।’
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান।