রবিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ঈদ হয়ে গেল আহাজারির

সিলেটে শোকের মাতম

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ ও শাহ্ দিদার আলম নবেল

মরদেহ শনাক্তের জন্য গতকাল স্বজনদের ভিড় জমে ঘটনাস্থলের পাশের ৫০ শয্যাবিশিষ্ট টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে। ভয়াবহ এই আগুনে একের পর এক মরদেহ নিয়ে আসতে দেখা যায় সেখানে। হাসপাতালের ভিতরের দোতলা ভবনের নিচতলার এক পাশে গেট আটকানো অবস্থায় পড়ে ছিল পুড়ে কয়লা হওয়া মরদেহ। গেটের বাইরে উত্সুক জনতা। কোরবানির ঈদ উদযাপনের জন্য বাড়িতে যাওয়ার ঠিক আগে দুর্ঘটনায় এখন শোকের মাতম স্বজন হারানো পরিবারগুলোতে। তাদের কাছে ঈদের আনন্দ পরিণত হয়েছে বেদনার আহাজারিতে।

একটি মরদেহের ওপর ছোট করে কাগজে লেখা সোলেমান (৩৫)। এ মরদেহটি গায়ের টি-শার্ট দেখে শনাক্ত করেন সোলেমানের স্ত্রী নাসিমা আক্তার। এ সময় নাসিমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘বাসা থেকে ভোর ৬টার দিকে কারখানায় কাজে যোগ দিতে যান সোলেমান। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই লোক মারফত জানতে পারি, কারখানায় আগুন লেগেছে। এখানে এসে দেখি সব শেষ।’ নাসিমা বলেন, এই কারখানায় কোনো নিয়মশৃঙ্খলা নেই। ভোর ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করাত। আমি বারবার আমার স্বামীকে বলেছিলাম, এ কারখানার কাজ ছেড়ে দিতে। তিনি বললেন, ঈদের পর ছেড়ে দেব। কিন্তু ছেড়ে তো দিল ঠিক, একেবারে দুনিয়া থেকে চলে গেল।’ সোলেমানের বড় ভাই সোহরাব বলেন, ‘আমার ভাই পাঁচ বছর যাবৎ এই কারখানার স্টোরে কাজ করছে। কিন্তু কী থেকে যে কী হলো বুঝতে পারলাম না।’ নিহত সোলেমানের বাড়ি কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরের আনুহা গ্রামে। তিনি আরিচপুর জামাইবাজার এলাকায় স্ত্রী-সন্তান ও মাকে নিয়ে থাকতেন। শুধু সোলেমান নয়, এমন পরিণতি ঘটেছে এ কারখানার অন্তত ২৬ জন শ্রমিকের ভাগ্যে। অন্যদিকে কারখানার আশপাশের লোকজন বলছেন, কারখানায় একেক শিফটে কাজ করেন সাড়ে তিনশ বা এর চেয়ে বেশি শ্রমিক। লাশ মিলল ২৬ জনের। তাহলে বাকি লোক গেল কোথায়! স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গোপালপুর এলাকায় থাকতেন ময়মনসিংহের প্রকৌশলী আনিসুর রহমান। সেই সকালে স্ত্রী-সন্তানকে ঘুমে রেখেই ডিউটিতে আসেন তিনি। হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভাঙে স্ত্রী নিগারের। বাইরে বেরিয়ে তাকিয়ে দেখেন আগুন ও ধোঁয়া বের হচ্ছে। খবর নিয়ে জানতে পারেন, তার স্বামী যে কারখানায় চাকরি করেন সেখানেই এ বিস্ফোরণ ঘটেছে। সাত বছর ধরে জেনারেটর ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন আনিস। গতকাল অফিস ছুটির পর কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা ছিল স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে। কিন্তু স্ত্রী ও সন্তানের জন্য ঈদের কেনাকাটা করা হলো না আনিসের। নিগারের বুকফাটা আর্তনাদে হাসপাতাল এলাকা ভারী হয়ে ওঠে।

এদিকে বাবা-মার সঙ্গে ঈদ করার জন্য গতকালই গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে যাওয়ার কথা ছিল অটোরিকশাচালক রাশিদের। গতকাল দুপুরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু না ফেরার দেশে চলে যেতে হলো তাকেও।

রাশিদের বোন মজিদা জানান, সকালে অটোরিকশা নিয়ে বের হন রাশিদ। ভোর ৬টার কিছু আগে বিসিক এলাকায় ট্যাম্পাকো কারখানা অতিক্রম করার সময় হঠাৎ বয়লার বিস্ফোরণের কারণে দেয়ালচাপা পড়ে তার ভাই মারা যান। রাশিদের স্ত্রী ও রনি নামে তিন বছরের এক ছেলে রয়েছে। এদিকে প্রত্যক্ষদর্শী মো. আপন বলেন, ‘সকালে বয়লার বিস্ফোরণের শব্দ পেয়ে ছুটে আসি। আমরা ১০-১২ জন মিলে সাতটি মৃতদেহ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। পরে বেলা দেড়টার দিকে আরও একজনের মরদেহ উদ্ধার করেছি।’ কারখানা-সংলগ্ন বাসিন্দা মরিয়ম আক্তার রিমা বলেন, ‘ঘুমন্ত অবস্থায় হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ভূমিকম্প হয়েছে ভেবে দৌড়ে ঘর থেকে বের হই।’ গতকাল সকালে অগ্নিকাণ্ডের পর ট্যাম্পাকো ফয়েলস নামে ওই কারখানা থেকে লাশ উদ্ধার করে টঙ্গী হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এতে টঙ্গী হাসপাতালেই ১৯ জনের মরদেহ ছিল বলে জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে টঙ্গী হাসপাতাল থেকে এসব মরদেহ ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য। ট্যাম্পাকো ফয়েলসের পাঁচতলা ওই কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণের পর আগুন ধরে যায় বলে জানিয়েছেন জয়দেবপুর ফায়ার স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. রফিকুজ্জামান।

তিনি বলেন, দুপুরে আগুন নেভানোর আগে বেশ কয়েকজনের লাশ বের করে আনা হয়। কয়েকজন হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান। এদের কেউ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছেন। আগুনে কারখানার কাঠামো ভেঙে পড়ে নিচে চাপা পড়ে মারা যান কেউ কেউ।

আহত অন্তত ৩৫ জনকে টঙ্গী সরকারি হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে দুই লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। গাজীপুর জেলা প্রশাসন নিহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে এবং আহতদের পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে।

কারখানার মালিক সিলেটের বিএনপিদলীয় সাবেক এমপি সৈয়দ মো. মকবুল হোসেন হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে গাজীপুর জেলা প্রশাসন। কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কারখানার মালিক সৈয়দ মো. মকবুল হোসেন জানান, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত তার এ কারখানায় সাড়ে চারশর মতো শ্রমিক রয়েছেন। সবার ঈদের বোনাসসহ বেতন-ভাতা কয়েক দিন আগেই পরিশোধ করা হয়েছে। এদিকে ভোর ৬টায় আগুনের খবর পেয়ে জয়দেবপুর, টঙ্গী, কুর্মিটোলা, সদর দফতর, মিরপুর ও উত্তরাসহ আশপাশের ফায়ার স্টেশনের ২৫টি ইউনিট নেভানোর কাজ করে বলে জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. রফিকুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ভোর ৬টার দিকে কাজ চলার সময় নিচতলায় বয়লার বিস্ফোরণের পর কারখানার পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। টঙ্গী রেল স্টেশনের কর্মী লিখন জানান, পাঁচতলা কারখানার চতুর্থ তলায় বেশ কিছু শ্রমিক জানালা দিয়ে হাত নেড়ে তাদের বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিলেন। এ সময় স্থানীয়রা মই নিয়ে শ্রমিকদের উদ্ধারের চেষ্টা চালান। কিন্তু ধোঁয়া ও তাপের কারণে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে কিছুক্ষণ পর ওই তলায় থাকা শ্রমিকদের আর কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে আগুন পুরো কারখানায় ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আশপাশের এলাকা। টঙ্গী হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. পারভেজ মিয়া জানান, হাসপাতালে ১৯ জনের লাশ আনা হয়েছিল। এ ছাড়া আহত ১২ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। গুরুতর কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার সাব্বির আহমেদ জানান, সেখানে দুজনকে নেওয়া হয়েছিল। তারা মৃত ছিলেন। লাশ তারা ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থশঙ্কর পাল জানান, আহতদের মধ্যে চারজন তাদের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। এর মধ্যে একজনের শরীরের ছয়ভাগ, আরেকজনের আট ভাগ পুড়ে গেছে। একজনের শরীরের ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সিলেটে পাঁচ নিহতের পরিবারে আহাজারি : ঢাকার গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্পনগরীতে প্যাকেজিং কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৪ জন। এর মধ্যে সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার পাঁচ ব্যক্তিও রয়েছেন। দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে তাদের বাড়িতে চলছে মাতম আর আহাজারি। প্রিয়জনদের অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদে স্বজনরা এখন শোকে স্তব্ধ। জানা যায়, টঙ্গীতে অবস্থিত ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেড নামক ওই প্যাকেজিং কারখানার মালিক সিলেটের গোলাপগঞ্জের আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামের ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন (লেচু মিয়া)। তিনি সিলেটের বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। কারখানা গড়ে তোলার পর নিজ এলাকার অনেককেই তিনি সেখানে চাকরি দেন। এ সুবাধে ওই কারখানায় গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের অনেকেই চাকরি করতেন। গতকাল শনিবার ভোরে ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডে বয়লারে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে নিহতদের মধ্যে পাঁচজন রয়েছেন সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার। এর মধ্যে কারখানার মালিক সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেনের নিজ গ্রামের রয়েছেন চার জন। গোলাপগঞ্জের নিহত পাঁচ ব্যক্তি হচ্ছেন—আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামের মৃত তমদির আলীর ছেলে ওয়ালি আহমদ কুটি (৩২), মৃত মজর আলীর ছেলে হাসান সিদ্দিকী রহিম (৪৮), সোনা মিয়ার ছেলে এনামুল হক (৩৮), মৃত তমজিদ আলীর ছেলে সাইদুর রহমান (৪৮) এবং কানিশাইল গ্রামের মৃত আবদুল করিমের ছেলে রেজওয়ান আহমদ (৩০)।

গোলাপগঞ্জের আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামের বাসিন্দা এবং বয়লার বিস্ফোরণে নিহত সাইদুর রহমানের চাচাতো ভাই এমরুল হাসান জানান, দীর্ঘ দিন ধরে এরা সবাই ওই কারখানায় কাজ করছিলেন। তিনি জানান, গোলাপগঞ্জের নিহত এই পাঁচ ব্যক্তির পরিবারে এখন আহাজারি চলছে। আকস্মিকভাবে দুর্ঘটনায় স্বজন হারানোর বেদনায় সবাই কাতর।

গতকাল শনিবার গোলাপগঞ্জের সুন্দিশাইল গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির বাড়িতে মাতম চলছে। স্বজন হারানোর ব্যথায় সবাই শোকাচ্ছন্ন। নিহতদের পরিবারের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আসন্ন ঈদের ছুটিতে বাড়িতে আসার কথা ছিল সবার। কিন্তু কারখানার আগুন জীবন থেকেই ছুটি দিয়েছে তাদের।

এদিকে ওই কারখানার মালিক গোলাপগঞ্জের আমুড়া ইউনিয়নের সুন্দিশাইল গ্রামের ড. সৈয়দ মকবুল হোসেন (লেচু মিয়া) বাড়িতে থাকেন না বলে জানিয়েছেন এমরুল হাসান। সপরিবারে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে আসেন তিনি। বর্তমানে তার গ্রামের বাড়ি দেখাশোনার জন্য পার্শ্ববর্তী বাড়ির একটি পরিবার সেখানে থাকে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর