শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

টেকনাফে চলে বদি শাসন

রাজনীতি, বৈধ ও অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যে তার একক নিয়ন্ত্রণ

মির্জা মেহেদী তমাল, টেকনাফ (কক্সবাজার) থেকে ফিরে

টেকনাফে চলে বদি শাসন

আশির দশকের কথা। টেকনাফে ছিলেন এজাহার মিয়া ওরফে এজাহার কোম্পানি। অক্ষরজ্ঞানহীন হলেও তিনি ছিলেন টেকনাফ-উখিয়ার রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেটের অন্যতম গডফাদার এই এজাহার মিয়ার রাজনীতির শুরু জিয়াউর রহমানের জাগদলে। পরবর্তী সময়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে। জাতীয় পার্টির টিকিটে নির্বাচিত হন টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান। এরপর একাধিকবার নির্বাচিত হন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে। সীমান্ত জনপদের এই গডফাদার একদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর সম্পদের মালিক হন, পাশাপাশি নানা কৌশলে রাজনীতিতে হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। কক্সবাজারে একসময় একটি কথা প্রচলিত ছিল, এজাহার কোম্পানি যেদিকে যান, সেদিকেই ঘোরে উখিয়া-টেকনাফের রাজনীতির চাকা। এই এজাহার মিয়ার দেখানো পথেই হাঁটা শুরু করলেন তার বড় সন্তান বদি, যিনি আজকের ক্ষমতাসীন দলের এমপি আবদুর রহমান বদি, যিনি বিতর্কিত কর্মকাণ্ড দিয়ে বিভিন্ন সময় হয়েছেন গণমাধ্যমের শীর্ষ সংবাদ। অবৈধ সম্পদ অর্জনের দুদকের মামলায় আবদুর রহমান বদিকে তিন বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। সরেজমিন কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ায় গিয়ে জানা যায়, বাবার কাছে ব্যবসা ও রাজনীতির হাতেখড়ি নিয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যান বদি। কক্সবাজার-৪ আসনের টেকনাফ আর উখিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, বৈধ-অবৈধ ব্যবসা সবই এখন তার একক নিয়ন্ত্রণে। আওয়ামী লীগের পোড় খাওয়া নেতাদের বাইরে রেখে বিএনপি-জামায়াত থেকে নেতা-কর্মী এনে রাজনীতিতে নতুন বলয় সৃষ্টি করেছেন বদি। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতাতেও আছেন সক্রিয়। যে কোনো নির্বাচনে তার ইচ্ছাতেই প্রার্থীরা এখন নির্বাচিত হন। টেকনাফ-উখিয়ায় তার কথাই শেষ কথা। তার হুমকি-ধমকি আর মারধরের কারণে সরকারি কর্মকর্তারাও তার বাইরে কোনো কথা বলেন না। অভিযোগ রয়েছে, দেশের নিসর্গ সুন্দর সীমান্ত জনপদ টেকনাফের চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অনিয়ম, দখল, ক্ষমতার দাপটের নজিরবিহীন সব কাণ্ড বদির জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। তার এবং তার পরিবারের কারণেই টেকনাফ এখন মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। এটি প্রশাসন জানলেও বুক চিতিয়েই আছেন তিনি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সারা দেশে যে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনা করছে, সেই সরকার নেই টেকনাফ-উখিয়ায়। এখানকার সরকার হচ্ছে বদির সরকার। তিনি তৈরি করেছেন ‘বদি লীগ’। এখানে চলে বদির শাসন।

রাজনীতিতে বদি : ১৯৯৫ সালের শেষের দিকে হঠাৎ  করেই বদিকে দেখা যায় জেলার রাজনীতিতে। উখিয়া-টেকনাফ আসনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে চালাতে থাকেন প্রচারণা। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে উখিয়া-টেকনাফ আসনে পান বিএনপিদলীয় মনোনয়ন। নির্বাচনের কিছুদিন আগে তার সেই মনোনয়ন কেড়ে নেওয়া হয়। এতেই বেঁকে বসেন বদি। যোগ দেন আওয়ামী লীগে। আওয়ামী লীগে এসে নৌকা প্রতীকের জন্য শুরু করেন জোর লবিং। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর টেকনাফ সদরকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৮ সালের দিকে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় হন সেই পৌরসভার প্রশাসক। এমপি পদে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে বদি ২০০২ সালে টেকনাফ পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েই নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। এর পর থেকেই হয়ে ওঠেন বেপরোয়া।

নিজস্ব বলয় : আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও দলের বাইরে গিয়ে আবদুর রহমান বদি উখিয়া-টেকনাফে নিজস্ব বলয় তৈরি করেছেন। সেখানে এটিকে বলা হয় ‘বদি লীগ’। দলীয় নেতা-কর্মীদের চেয়ে নিজ অনুগতদের মাধ্যমে পরিচালনা করেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। এ ক্ষেত্রে অনুগতদের রাজনৈতিক পরিচয়ও তার কাছে গৌণ। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের অনেক নেতা-কর্মী তার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে হয়ে উঠেছেন নব্য আওয়ামী লীগার, যাদের দাপটে পোড় খাওয়া অনেক আওয়ামী লীগ কর্মী সংগঠন থেকে দূরে সরে গেছেন। প্রতিবাদ করে কেউ কেউ এলাকা থেকেও হয়েছেন বিতাড়িত। সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনেও এর প্রমাণ মিলেছে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় বদির পছন্দের বেশির ভাগ প্রার্থীই চেয়ারম্যান বা অন্য পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হন। পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বদির সহায়তায় বিজয়ী হন। শুধু নিজ সংগঠনের বিদ্রোহী প্রার্থী নন, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নে বিএনপির গফুর উদ্দিন চৌধুরী ও টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নে জামায়াতের প্রার্থী নূর আহমদ আনোয়ারীও এমপি বদির সহায়তায় ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

হ্নীলা ইউপি নির্বাচনের এক সপ্তাহ পর সেখানে অনুষ্ঠিত এক সংবর্ধনা সভায় এমপি বদি নিজেই বলেছেন, ‘আমি যাদের চেয়েছি, তারাই নির্বাচিত হয়েছেন।’

জানা গেছে, এমপি বদি এলাকায় বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন, যার যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। তিনি গত উপজেলা নির্বাচনে টেকনাফে তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পৌর বিএনপির সভাপতি জাফর আলমকে প্রভাব খাটিয়ে নির্বাচিত করেন। ওই নির্বাচনে পরাজিত হন সাবেক সংসদ সদস্য উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি অধ্যাপক মো. আলী। একইভাবে পরাজিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ইউনুছ বাঙ্গালীও। এ পদে জঙ্গি-সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে এমন একজনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এমপি বদি তাকেও পাস করিয়ে আনেন। একইভাবে তার কৌশলের কাছে হেরে যান বিগত ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত উখিয়ার বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী।

এ বিষয়ে কথা হলে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কর্মকাণ্ড চালানো একজন সংসদ সদস্য এখনো কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে বিভিন্ন ফোরামে অবস্থান করেন তা মাথায় আসে না।

উখিয়া-টেকনাফে ‘বদি সরকার’! : সারা দেশে দারিদ্র্য হ্রাসসহ সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে বর্তমান সরকার ভিজিএফ, ভিজিডিসহ জনবান্ধব নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চললেও কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের মানুষ সরকারের এসব কর্মসূচি সম্পর্কে কিছুই জানে না। দীর্ঘদিন ধরে এসব কর্মসূচি স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন। অথচ আওয়ামী লীগের গত সম্মেলন ও কাউন্সিল অধিবেশনেও দলীয় সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকারের জনবান্ধব কর্মসূচি তৃণমূলের সাধারণ মানুষের কাছে ছড়িয়ে দিতে বলেন। বাস্তবে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে প্রধানমন্ত্রীর এ রকম ঘোষণার উল্টোটাই প্রচারের অভিযোগ রয়েছে।

উখিয়ার জালিয়া পালং ইউনিয়নের আহম্মদ মাঝি জানান, সম্প্রতি সরকারিভাবে কেজিপ্রতি ১০ টাকায় ৩০ কেজি করে যে চাল দেওয়া হয়েছে তা এমপি বদির উদ্যোগেই। তিনি ছাড়াও ইউনিয়নের রেজু ঘাটঘর ব্রিজ এলাকার নুরুল ইসলাম, সোনা আলী, রহমত উল্লাহসহ অনেকেই এ সুবিধা পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সম্প্র্রতি ২২ দিন সাগরে মাছধরা বন্ধ থাকায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জেলেদের বিনা মূল্যে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হচ্ছে। আমরা এ চালও পাব। কিন্তু এলাকার সবাই জানে, এসব চাল এমপি বদিই দিচ্ছেন।’ হলদিয়া পালং ইউনিয়নের পশ্চিম রুমখা পালং গ্রামের মৃত সালেহ আহম্মদের ছেলে সৈয়দ কাসিম বলেন, ‘আঁরার এমপি আঁরারে ১০ টেয়া দামর চইল হাবার। আঁরা খুব খুশি। সরকারে দিয়ে না হনে দিয়ে আঁরা নজানি, আঁরা জানিদে ইন এমপি বদি দের।’ এ প্রসঙ্গে উখিয়া-টেকনাফ সংসদীয় আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আসলে এমপি বদি বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে আসার কারণে তিনি সব সময় দুর্বলতায় ভোগেন। তিনি শঙ্কায় থাকেন, যে কোনো সময় আওয়ামী লীগ থেকে ছিটকে পড়তে পারেন। এ জন্যই এমপি বদি উখিয়া-টেকনাফে সরকার ও নিজ দলের বাইরে আলাদা বলয় তৈরি করেছেন।’ তিনি জানান, এ রকম বলয়ের কারণেই বিগত ইউপি নির্বাচনে তিনি উখিয়া-টেকনাফের ইউপি নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীদের পক্ষে নীরব সমর্থন দিয়ে তাদের জিতিয়ে নিয়েছেন।

টেকনাফে ইয়াবা : বাংলাদেশে ইয়াবা আসে মিয়ানমার সীমান্তপথে টেকনাফ হয়ে। স্থানীয়দের প্রশ্ন, এ পাচারে এমপি আবদুর রহমান বদির পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে টেকনাফ কেন ‘ইয়াবা নগরী’ হবে? এমপি বদির ভাই ও আত্মীয়স্বজন নিয়ন্ত্রণ করে ইয়াবা পাচারের কাজ। ক্ষমতার কাছে থাকায় ইয়াবার গডফাদাররা সব সময়ই থাকে প্রশাসনের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বারবার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্রশাসন, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম এলেও তারা প্রকাশ্যেই ইয়াবার রাজ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইয়াবা পাচারকারীরা এতটাই প্রভাবশালী যে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকে বিষয়টি তুলতেও কেউ সাহস করে না।

বদির হাতে এ পর্যন্ত প্রহৃত হয়েছেন ২৪ বিশিষ্ট ব্যক্তি। কথায় আছে, এমপি বদির কথার বাইরে গেলে তিনি নিজ হাতে এর ‘বিচার’ করেন। তার হাতে এ পর্যন্ত হামলা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার ২৪ জন। হামলা ও নির্যাতনের পাশাপাশি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও করেন বদি, যে কারণে সরকারি কর্মকর্তারা তার কথার বাইরে যান না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর