মঙ্গলবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদেশিরাও মশগুল বাংলা প্রেমে

ভাষা, গান, নাচ শিখছেন ৬৮ বিদেশি কূটনীতিক ও বহুজাতিক সংস্থার কর্মকর্তা

জুলকার নাইন

কেবল বাংলা ভাষা শিখতে এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন ৩৫ জন বিদেশি নাগরিক। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, কোরিয়াসহ ১৭ দেশের এসব নাগরিক বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রেমে পড়েছেন। তারা ঢাকার বনানীর ‘লার্ন বাংলা’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বাংলা শিখছেন।

শুধু বাংলা ভাষা নয়; বাংলা গান, নাচ ও কবিতাও তাদের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। এই ৩৫ জনের পাশাপাশি বাংলাদেশে কর্মরত মার্কিন, জাপানি কূটনীতিকসহ বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের আরও ৬৮ বিদেশি বাংলা শিখছেন বনানীর এই প্রতিষ্ঠানের আওতায়। বিস্মিত হতে হয় রুমানিয়ার নাগরিক অক্টেভিয়ান রেতেগানের কণ্ঠে কবি সুফিয়া কামালের ‘জন্মেছি এই দেশে’ কবিতার মনোমুগ্ধকর আবৃত্তিতে। একই সঙ্গে ‘বসন্ত এসে গেছে’ গানের সঙ্গে ব্রিটিশ এলিজাবেথ সিম্পসন ও অস্ট্রীয় লিডিয়া স্ট্রেলিয়ান দৃষ্টিনন্দন পরিবেশনায় বিস্ময়ের ঘোর কাটে না।

জানা যায়, একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশি প্রতিবন্ধী শিশুদের সাহায্য করার লক্ষ্যে বাংলা শিখছেন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক হে-জিন। বস্তি এলাকায় বাচ্চাদের ইংরেজি শেখানোর কাজ করার জন্য আগে নিজে বাংলা শিখছেন চীনা নাগরিক সো-কাম লিন। দক্ষিণ এশিয়ায় বসবাস ও কাজের দরজা উন্মোচনের জন্য বাংলা শিখছেন নিউজিল্যান্ডের জন মেকমুলান। মার্কিনি জেফির মেইয়ার ভাষা শিখে বাঙালির সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করতে চান। নতুন কিছু শেখার আগ্রহ থেকেই বাংলায় মেতেছেন ফিনল্যান্ডের আরিয়া তইভাইনেন ও ইন্দোনেশিয়ার আপনের নাপাদা বিহার। আর বাঙালি স্বামীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে বাংলা শিখছেন কানাডার ডানিয়েলা লালন্ডে মাসুদ।

‘লার্ন বাংলা’র কর্মকর্তারা জানান, সাত বছর ধরে বাংলাদেশে বিদেশিদের বাংলা ভাষা শিক্ষা দিয়ে আসছে অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠানটি। বনানী ও উত্তরায় মোট ১৫টি শ্রেণিকক্ষে নেওয়া হচ্ছে ক্লাস। আন্তর্জাতিক মানের কোর্স কারিকুলামে ভাষা শিক্ষা দিচ্ছেন দেড় ডজন প্রশিক্ষক। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজারেরও বেশি বিদেশিকে বাংলা শিখিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বাংলায় কথা বলা, শুদ্ধ উচ্চারণ, শোনা, পড়া এবং লেখার দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি শিক্ষার্থী-শিক্ষক-সাধারণ মানুষের মাঝে সম্পর্ক তৈরির কাজ করে যাচ্ছে লার্ন বাংলা। এবার একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষেও বড় আয়োজন করা হয়েছে। ১৫টি ভাষায় গাওয়া হয়েছে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, নরওয়েজিয়ান, ফিনিশ, হিন্দি, ইথিওপিয়ান, ডাচ্, রুমানিয়ান, মোঘামো, রাশিয়ান, কম্বোডিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, চাইনিজ, কোরিয়ান ও জাপানিজ ভাষায় একুশের গান কণ্ঠে তুলেছেন বিদেশিরা। আজ একুশে ফেব্রুয়ারিতে শাড়ি ও পাঞ্জাবি পরে বিদেশিরা যাবেন শহীদবেদিতে ফুল দিতে এবং দিনের বড় অংশই তাদের কাটবে একুশের নানান অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে।

প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক দিল আরা লীনা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, স্পেন, সুইজারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইতালি, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, এল সালভাদর, থাইল্যান্ড, পূর্ব তিমুর, নাইজেরিয়া, ব্রুনাই, ভারতসহ বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশের নাগরিককে বাংলা শেখানো হয় এখানে। এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি বিদেশি নাগরিক এখানে বাংলা ভাষা শিখেছেন। বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তা, স্টুডেন্ট ভিসায় যারা বাংলাদেশে পড়তে এসেছেন, বিদেশি এনজিওসহ ব্যবসা ও গবেষণার কাজে যেসব বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে অবস্থান করছেন এবং যারা ট্যুরিস্ট হিসেবে এ দেশে এসেছেন তারাই ‘লার্ন বাংলা’য় বাংলা শিখছেন। এ ছাড়া কলকাতায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের নাগরিকও ‘লার্ন বাংলা’র সহায়তায় বাংলাদেশে আসছেন বাংলা শিখতে। তিনি জানান, আগে প্রায় সব বিদেশিই বনানী ও উত্তরার ক্লাসরুমগুলোয় এসে ভাষা শিখলেও এখন বাইরেও শেখানো হচ্ছে। হলি আর্টিজানের ঘটনার পর থেকে মার্কিন দূতাবাস ও জাইকায় কর্মরত অর্ধশতাধিক বিদেশিকে সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে ভাষা শেখানো হচ্ছে। সূত্রমতে, লার্ন বাংলার প্রতিষ্ঠাতা মেরি জুলিয়েট পিনারু বাংলা ভাষা শেখাচ্ছেন ১৫ বছর ধরে। তিনি শুরু করেছিলেন একটি এনজিওতে শিক্ষক হিসেবে। সেখানে পড়তে আসতেন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা। এনজিওটির বাংলা ভাষা শিক্ষণ কোর্স ছিল সংক্ষিপ্ত। শিখতে আসা বিদেশিরা চাইতেন আরও বৃহৎ পরিসরে বাংলা ভাষা শিখতে। ২০১০ সালের পয়লা বৈশাখে স্বামী লেনিন পিনারুর সহযোগিতায় বনানীতে চালু করেন লার্ন বাংলা। প্রথম বছরই বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিক, কর্মকর্তাসহ ২৫ বিদেশিকে শেখানো হয় বাংলা। এখানে বাংলা শেখার সুবিধার্থে মডিউল, ফ্লাশচার্ট, অডিও ভিজুয়াল, অডিও সিডি ব্যবহার করছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব প্রকাশনাও আছে ১৫টির বেশি। লাইব্রেরিতে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ৫০০ বই রয়েছে। শুধু বাংলা ভাষা নয়, বাংলাদেশি রান্না, সংগীত, নাচ, সাহিত্য, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতিসহ বাঙালি সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের সঙ্গে পরিচয় করানো হয় এখানে। বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিদেশি নাগরিকরা সেখানে বাংলায় গান, অভিনয়, আবৃত্তি, নাচসহ নানা কিছুতে অংশ নেন।

সর্বশেষ খবর