সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভোগান্তির শেষ নেই

ঘাটে ঘাটে হয়রানি, থানায় জিডি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি, গ্যাস বিদ্যুৎ পানি টেলিফোন সংযোগ, রেল ও বিমানের টিকিট সোনার হরিণ, রাস্তাঘাটে দুর্ভোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

ভোগান্তির শেষ নেই

সাধারণ মানুষের যাওয়ার যেন কোথাও জায়গা নেই। থানায় গেলে দুর্ভোগের জিডি নেয় না পুলিশ। তদবির বা কিছু ধরিয়ে দিলেই আবার সহজে তা মিলছে। একইভাবে চলছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। হাসপাতালে ভর্তির সমস্যা। ভর্তি হলেও সিট মেলে না। আবার সিট মিললেও সেবা নেই। সন্তানদের জন্য ভালো স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানো রীতিমতো এখন কঠিনতম কাজ। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বা সরকারি টেলিফোন সংযোগ সোনার হরিণ। বড় ধরনের তদবির বা গোপনে সিস্টেমে না গেলে সরকারি কোনো কাজের ধারেকাছেও ঘেঁষা যায় না। একই পরিস্থিতি রেল বা বিমানের টিকিট পেতে। কালোবাজারিরা রেলের টিকিট পেলেও পান না সাধারণ যাত্রীরা। বিমানের টিকিট কিনতে গেলেই শুনতে হচ্ছে ‘টিকিট নেই’। অথচ যে ফ্লাইটের টিকিট নেই বলে যাত্রীকে ফেরত দেওয়া হলো, সেই ফ্লাইটটি ডানা মেলছে সিট ফাঁকা নিয়ে। আর বাসা থেকে বের হলেও মানুষকে পড়তে হচ্ছে নানা ভোগান্তিতে। বিশেষ করে গণপরিবহনের চরম নৈরাজ্যে সাধারণ মানুষ অসহায়। কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা নেই। ইচ্ছামতো ভাড়া তোলা হচ্ছে গণপরিবহনে। সিএনজি চালিত অটোরিকশা কারও নিয়ন্ত্রণে নেই। মিটারে তারা এখন আর গন্তব্যে যায় না। বেশি টাকায় যেতে হচ্ছে যাত্রীসাধারণকে। প্রতিটি ঘাটে ঘাটে এভাবেই চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের প্রতিটি স্তরে ঘুষ, দুর্নীতি ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এ ব্যাধি থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের বেশ কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার সাধন করা এবং উন্নয়ন ঘটানো। এ জন্য আমাদের রাজনীতিক, মন্ত্রী, আমলা আর দেশের মানুষের মানসিকতার পরিবর্তনেরও কোনো বিকল্প নেই।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেছেন, নাগরিকদের ভোগান্তির জন্য প্রশাসনিক অদক্ষতাই দায়ী এবং আরও দায়ী দুর্নীতি। যাকে যে দায়িত্বে যেখানে বসানো হয়েছে, সেই দায়িত্ব ঠিকমতো পালিত হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্তব্যে অবহেলা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। যার ফলে সব সেক্টরে এক ধরনের স্থবিরতা এসেছে। যে সেবা নাগরিকদের পাওয়ার অধিকার আছে। সেই সেবা থেকে নাগরিকরা বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত মানুষের এ ভোগান্তির শেষ হবে না। এলজিইডির সাবেক প্রধান প্রকৌশলী শহীদুল হাসান বলেছেন, নাগরিকদের ভোগান্তির মূলত দুটি প্রধান কারণ। ১. সুশাসন ও জবাবদিহিতার অভাব। ২. সব সেক্টরে দুর্নীতি। তিনি বলেন, আমাদের জনসংখ্যা বেশির কারণে চাহিদাও বেশি। আর চাহিদার তুলনায় সীমাবদ্ধতাও আছে। আর দুর্নীতির কারণেও জনগণ সেবা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, দুর্নীতিতে দেশ ছেয়ে গেছে। থানায় তো ব্রিটিশ আমলে দুর্নীতি ছিল। কেননা একজন পুলিশ যখন চাকরি শুরু করেন তখন তিনি ঘুষ দিয়ে চাকরি নেন। ফলে দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি চাকরি নিচ্ছেন। এই সাবেক প্রকৌশলী বলেন, সব ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও সুশাসন চালু হলে নাগরিকের ভোগান্তি কমবে।     

সরকারি অফিসে শুধু ঘুষ : সরকারি দফতরগুলোতে ঘুষ ছাড়া কোনো কথাই নেই। এসব দফতরে যেন ঘুষের মেলা বসে। ঘুষ নেই তো ফাইল অনড়। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এ অবৈধ কাণ্ডে লিপ্ত থাকেন সারাক্ষণ। দফতরগুলোর কোনো কোনো কক্ষে ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থাকে। তারপরও অর্থের অবৈধ লেনদেন থেমে নেই। টেবিলের নিচ দিয়ে বা ফাইলের ভিতর দিয়ে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হাতে, অতঃপর পকেটে। টিআইবির একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, বিদ্যুৎ খাত, গ্যাস, পাসপোর্ট ও বিচারিকসহ অন্তত ১৬টি খাতের সেবা পেতে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে দেশের মানুষকে। আর এ ভোগান্তিতে পড়ে মানুষকে বছরে ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

ভোগান্তির নাম সরকারি হাসপাতাল : খোদ রাজধানীতেই সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাসেবা নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বড় বড় হাসপাতাল আছে, চিকিৎসা সরঞ্জামেরও অভাব নেই, শুধু সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বহীনতায় সেবাবঞ্চিত থাকছেন রোগীরা। ডাক্তারের অবর্তমানে ওয়ার্ডবয় আর নার্সদের গাফিলতিতে আয়ারা হয়ে ওঠেন সর্বেসর্বা। আছে দালালদের সীমাহীন উৎপাত। হাসপাতালে ভর্তি করতে দালাল, ওয়ার্ডে বেড পাওয়া নিশ্চিত করতে দালাল, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেও দালালদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। পঙ্গু ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রোগীর জন্য ট্রলি ব্যবহার করতেও টাকা গুনতে হয় স্বজনদের। রোগীদের জন্য বরাদ্দ থাকা ট্রলি নিয়ন্ত্রণে রেখে মিটফোর্ড হাসপাতালেও বাড়তি টাকা কামায় বহিরাগতরা। ছুটির দিন আর রাতে হাসপাতালগুলোর চেহারা যেন আমূল পাল্টে যায়। বহু খোঁজাখুঁজি করেও ডিউটি ডাক্তারদের সন্ধান পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। দরজা আটকে বিশ্রামে থাকা নার্সদের ডাকলে রীতিমতো রক্তচক্ষু দেখতে হয়। রাজধানীর প্রধান হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিটফোর্ড হাসপাতালের আঙ্গিনাসহ চারপাশজুড়ে ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। পঙ্গু আর শিশু হাসপাতাল ঘিরে আছে ঝুপড়ি বস্তি আদলের ঘরবাড়ি। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ঘিরে গড়ে ওঠা দোকানপাট শতেক জঞ্জালে ঠাসা। পিজি হাসপাতাল চত্বরে বহিরাগতদের আনাগোনা বন্ধ হলেও মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতাল আঙ্গিনা থেকে নেশাখোর, ভবঘুরেদের হটানোই যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে রাজধানীর সরকারি হাসপাতালগুলোর বেহাল দশায় চিকিৎসাসেবার পরিবর্তে দিনদিনই রোগী ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করছে।

গ্যাস নেই, আছে বিল : ইন্দিরা রোডের আবদুস সোবহান। একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এসেছেন ফার্মগেটের নিউ সুপার স্টার রেস্তোরাঁয়। এসেই বলছেন— কী বিপদে পড়লাম, গ্যাসের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে গেছি। মিরপুরের বাসিন্দা রেশমা বেগম। একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করেন। সকালের নাশতা কিনতে বের হয়েছেন। কারণ, বাসায় গ্যাস নেই। তাই বাচ্চাদের জন্য বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে যাবেন। সকাল থেকেই গ্যাসের চাপ কম থাকায় রান্না করতে পারেননি মালিবাগের শান্তা ইসলাম। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার বাইরেই খাবেন। বিকাল ৪টার পর গ্যাস স্বাভাবিক হলে রাতের রান্না করবেন। বনশ্রীর ফাতেমা জানান, ভোরেই গ্যাস চলে যায়। আসে সন্ধ্যার দিকে। সারা দিনই গ্যাসের দেখা পাওয়া যায় না। রাতেই সব রান্না একবারে করে রাখেন। তিনি জানান, দিনে এখন আর রান্না করা যায় না। গ্যাসের চাপ এত কম থাকে যে, পানি গরম হয় না। সকালে উঠেই দেখি এই অবস্থা। রাজধানীজুড়েই এখন এ অবস্থা। অথচ গ্যাসের বিল বাড়ছে। নতুন সংযোগও পাওয়া যায় না।

গণপরিবহনে নৈরাজ্য : রাজধানীর মিরপুরের কালশী সড়কের মাটিকাটা অংশে ইসিবি চত্বর থেকে জিল্লুর রহমান ফ্লাইওভারের এমাথা-ওমাথার দূরত্ব মাত্র ১ কিলোমিটার। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই পথটুকুর সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা পাঁচ টাকা। অথচ গণপরিবহনগুলো এর ভাড়া আদায় করছে ২৫ টাকা। কোনো যাত্রী এতে আপত্তি করলেই তাকে বলা হয় ‘এটি সিটিং গাড়ি’। ভাড়া নিয়ে এমন অত্যাচার শুধু এখানেই নয়, চলছে রাজধানীজুড়েই। এসব ছাড়াও গণপরিবহন নিয়ে আছে আরও নানা সমস্যা ও অভিযোগ।

রাজধানীতে জনসংখ্যা বাড়লেও কমছে গণপরিবহন। আর এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন গণপরিবহনের চালকরা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, সিটিংয়ের নামে প্রতারণা, কম দূরত্বে যাত্রী না উঠানো ও সরকারি গণপরিবহন বিআরটিসির অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে জনবহুল নগরীর গণপরিবহনগুলো। এসব পরিবহনের চালকদের কাছে অনেকটাই জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। গণপরিবহনের এমন ভয়াবহ নৈরাজ্যের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে নগরবাসী।

রাস্তায় ভোগান্তি : স্যুয়ারেজ লাইল সংস্কারের কাজ চলছে মিরপুরের সেনপাড়া পর্বতা এলাকায়। রাস্তা খুঁড়ে বসানো হচ্ছে পাইপ। কিন্তু পাইপ বসানোর পর রাস্তা থেকে খোঁড়াখুঁড়ির অতিরিক্ত মাটি সরানো হচ্ছে না। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে ওই এলাকার অলি-গলি পথ। বাসাবাড়ির সামনে গড়ে উঠেছে অতিরিক্ত মাটির পাহাড়। রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করতে পারছে না শিশু-কিশোর, ছাত্রছাত্রী ও বয়স্করা। মাটি রেখে রাস্তা বন্ধ করায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। এলাকাবাসীর দাবি— একটি পাইপ বসানোর কাজ শেষ হবে, আর তাত্ক্ষণিকভাবে ওই এলাকার অতিরিক্ত মাটি রাস্তা থেকে সরাতে হবে। তা হলে মানুষের চলাচলে ভোগান্তি হবে না। এ অবস্থা শুধু মিরপুর নয়। এ চিত্র রাজধানী ঢাকার। দেখা গেছে, ভিশন গার্মেন্ট থেকে ইটখোলা বাজার হয়ে মাতবরের পুকুরপাড় পর্যন্ত স্যুয়ারেজ লাইনের কাজ চলছে। কিন্তু রাস্তা খোঁড়ার পরে অতিরিক্ত মাটি সরানো হচ্ছে না। দোকান-বাসার সামনে তা স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এতে চলাচলের পথ বন্ধ হয়েছে।  বাসা মালিকদের অভিযোগ— ১৫ থেকে ২০ দিন হলো পাইপ বসানোর কাজ হচ্ছে কিন্তু একমুট মাটিও সরানো হচ্ছে না। ঠিকাদার নিজের খরচ বাঁচাতে রাস্তায় মাটির স্তূপ করে রাখছেন। যাতে পরে পাইপের পাশে বালি না দিয়ে, মাটি দিয়ে ভরাট করতে পারেন। এ ছাড়া কাজ নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে তাদের। এক বাসিন্দা বলেন, কাজ অনেক নিম্নমানের হচ্ছে। পাইপের দুই পাশে পিট গাঁথা হচ্ছে। কিন্তু সিমেন্টের পরিমাণ কম দেওয়া হচ্ছে। এতে কয়েক মাস পরে তা নষ্ট হতে পারে।  এলাকাবাসী জানিয়েছে, গতকালের বৃষ্টিতে রাস্তায় হাঁটু কাদা হয়েছে। আর সামনে বর্ষা মৌসুম। এমন ধীরগতিতে কাজ করলে বাসা থেকে লোকজন বাইরে বের হতে পারবে না। বাসায় বসে থাকতে হবে। কেননা বাসার সামনের রাস্তা বন্ধ থাকলে মানুষ বের হবে কেমন করে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর