শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩ মে, ২০১৮ ০০:০০ টা
ভয়াবহ প্রতারণা ব্যাক টু ব্যাক এলসিতে

ভুয়া কাগজপত্রে অর্থ পাচার

মানিক মুনতাসির

ব্যাক টু ব্যাক ভুয়া এলসি (ঋণপত্র) খুলে এবং জাল কাগজপত্রে মর্টগেজ দিয়ে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট করছে একটি চক্র। শুধু তাই নয়, যে পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানির এলসি খোলা হয়, বাস্তবে সে পরিমাণ পণ্য আমদানি-রপ্তানি না করেই বিল পরিশোধের মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ঢাকা ব্যাংকের একটি শাখায় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে জালিয়াতির একটি ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে ধরা পড়েছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই জালিয়াত চক্রকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ চিহ্নিতও করেছে। প্রতারক এই সিন্ডিকেট বিভিন্ন ব্যাংকে এভাবেই প্রতারণা করে থাকে। ঢাকার প্রতারক এই সিন্ডিকেট একটি বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দুদক ও গোয়েন্দা সংস্থা তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে। এ ছাড়া গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথম শ্রেণির আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জাল দলিলপত্র জমা নিয়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের দায়ে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে শিল্পের কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আমদানির নামে ব্যাক টু ব্যাক ভুয়া এলসি খুলে জালিয়াতির মাধ্যমে গত কয়েক বছরে ব্যাংক খাত থেকে অন্তত কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। মর্টগেজ হিসেবে দেখানো পণ্য বা জমির ভুয়া দলিল দিয়ে এলসি খুলছে এ চক্রটি। মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে এলসির কাগজপত্র তৈরি করে অন্য ব্যাংকে তা বিক্রি করে তুলে নিচ্ছে টাকা। এসব ঘটনায় খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের একাধিক ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি চক্র সুকৌশলে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে নিজেরাই আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক সেজে ব্যাংকের টাকা লুটে নিচ্ছে। কেউ কেউ এই ব্যাক টু ব্যাক ভুয়া এলসির আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশ থেকে পাচার করে দিচ্ছে। অনেক সময় ব্যাংক সরল বিশ্বাসে ওদের কবলে পড়ছে। আবার অনেক সময় ঝামেলায়ও পড়ছে। ভুয়া কাগজপত্র যাচাই-বাছাইও অনেক সময় সম্ভব হয় না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ব্যাক টু ব্যাক এলসির আড়ালে অর্থ পাচারের ঘটনা নতুন নয়। তবে বর্তমানে এমন ঘটনা অনেক বেশি ঘটছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগের কর্মকর্তাদেরও সচেতনতা বাড়াতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

বেসরকারি এনসিসি ও মেঘনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘এলসি নিয়ে নানা ধরনের কারসাজি হচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় হাজার হাজার ব্যাক টু ব্যাক বেনামা এলসি খোলা হচ্ছে। সেগুলো অন্য ব্যাংকের কাছে বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ওইসব এলসির সংশ্লিষ্ট কোম্পানির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। এতে কোনো কোনো ব্যাংক কর্মকর্তারও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এসব ঘটনায় ব্যাংকিং খাত থেকে অনেক টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র বলে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংক অন্য ব্যাংকগুলোকে সতর্কও করে আসছে। ফলে ব্যাংকগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে এলসি খুলতে হবে।’ জানা গেছে, সম্প্রতি তৈরি পোশাক খাত ও জাহাজভাঙা শিল্পের প্রয়োজনীয় মালামাল আমদানির জন্য খোলা বিপুলসংখ্যক ব্যাক টু ব্যাক এলসি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে খোদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। শুধু তাই নয়, সংঘবদ্ধ এ চক্রটি ভুয়া কাগজপত্র জমা দিয়ে ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের ঋণও অনুমোদন করিয়ে তা আত্মসাৎ করছে। এ ধরনের ভয়াবহ জালিয়াত চক্রের সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংকের অসৎ কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে বলে মনে করে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ধরনের ঘটনা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোয় বেশি ঘটছে। তবে বেসরকারি খাতের অন্তত অর্ধেকসংখ্যক ব্যাংকেও এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনার নজির রয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গার্মেন্ট, ভোজ্যতেল, অপরিশোধিত চিনি, গাড়ির যন্ত্রাংশ, কৃষি সরঞ্জামসহ নতুন নতুন খাতে আমদানির বিপরীতে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। দেশের বৃহৎ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এসব জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বৃহৎ আকারে এলসি জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বেশির ভাগ ইস্যুই ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার ঘটনা। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন কারেন্সি বিভাগ ও পরিদর্শন বিভাগ যৌথভাবে এসব জালিয়াতির ঘটনা তদন্ত করছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) এ নিয়ে কাজ করছে। শুধু বেসরকারিই নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও গত কয়েক বছরে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা এলসি জালিয়াতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব ঘটনা রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও সচেতনতা ও নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সর্বশেষ খবর