শনিবার, ২৩ জুন, ২০১৮ ০০:০০ টা

বড় দুই দলের বড় নেতাদের প্রচারণায় মুখরিত গাজীপুর

খায়রুল ইসলাম, গাজীপুর

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের আর বাকি মাত্র তিন দিন। নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন চলছে জমজমাট প্রচারণা। মূলত প্রার্থীরা শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত রয়েছেন। গতকালের প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন বড় দুই দলের বড় নেতারা।

আওয়ামী লীগ : আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচারণা চালাচ্ছেন। গতকাল সকাল ৯টার দিকে তার নিজ বাসভবনের সামনের উঠানে তাবলিগ জামাতের মুরব্বি এবং শতাধিক সাথী ভাইয়ের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে গণসংযোগ শুরু করেন। এ সময় জাহাঙ্গীর আলম ওলামাদের দোয়া নেন এবং সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি পরিকল্পিত নগরী গড়ার লক্ষ্যে ২৬ জুন নির্বাচনে সহযোগিতা ও ভোট চান। তাবলিগের মুরব্বি মোনাজাতে জাহাঙ্গীরের সাফল্য প্রত্যাশা করে মহান আল্লাহর রহমত কামনা করেন।

এ ছাড়া জাহাঙ্গীর আলম মহানগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কলাবাগান এলাকায় পথসভায় বক্তব্য রাখেন। পরে ২০ ওয়ার্ডের মজলিশপুর, ২২ এ বাংলাবাজার, ২১ এ বিপ্রবর্থা, ২৩ নম্বরের খালপাড়া পথসভায় ভোটারদের সহযোগিতা ও ভোট চান। চান্দনা চৌরাস্তা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। শেষে মসজিদ আঙিনায় মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি ইসলামিক দল এবং ইসলামিক সংগঠনের যারা আলেম আছেন- তাদের সবার সহযোগিতা চেয়েছি। মহানগরীর ১৮০০ মসজিদের খতিব, সাড়ে ৪০০ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং তাবলিগ জামাতের মুরব্বিরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমাকে নৌকা মার্কায় সমর্থন দিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। আমাকে ভোট দেন, নৌকাকে ভোট দেন। আমি ক্লিন এবং গ্রিন সিটি উপহার দিতে চাই। সবাইকে একটি বাসযোগ্য শহর দিতে চাই।’ বিকাল ৩টার দিকে বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ফটকের সামনে পথসভার মাধ্যমে তিনি দ্বিতীয় দফা প্রচারণা শুরু করেন। পরে ১৬ নম্বরে আক্তার মার্কেট, ১৮ নম্বরে টিএন্ডটি রোড, শাপলা ম্যানশন ও অনুপম সুপার মার্কেটে পথসভার মাধ্যমে ভোট প্রার্থনা করেন। মাঝে টঙ্গীতে মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ সভায় যোগ দেন।

প্রচারণায় কেন্দ্রীয় নেতারা : খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক সকাল থেকে গাজীপুর সিটি মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে পথসভা এবং গণসংযোগ করেন। কেন্দ্রীয় নেতা ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন সকালে টঙ্গীতে এবং চান্দনা চৌরাস্তা কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজের পর প্রচারণা চালান। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন নগরীর ২৬ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নির্বাচনী কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। ওলামা লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আখতার হোসেন বোখারী মহানগরীর ৪০, ৪১ নম্বর পূবাইল এলাকায় গণসংযোগ করেন। টাঙ্গাইল কালিহাতী উপজেলা চেয়ারম্যান মাজহুরুল ইসলাম তালুকদার টঙ্গীতে প্রচারণা চালিয়েছেন। 

প্রচারণায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি : আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা একসঙ্গে মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে দোয়া চেয়েছেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্ব স্ব দলের মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় এসে গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়ে এই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সেখানে বিএনপির কেন্দ্রীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খোন্দকার মোশারফ হোসেন, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফজলুল হক মিলন, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন ও উভয় দলের স্থানীয় নেতারা একসঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করেন। নামাজের আগে তারা মুসল্লিদের সালাম দেন এবং দোয়া চান। নামাজ শেষে মসজিদের বাইরে নেতারা  হাতে হাত ধরে মুসল্লিদের  সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করে একসঙ্গে ক্যামেরাবন্দী হন। এ সময় নওফেল বলেন, এই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ প্রমাণ করে বর্তমান সরকার একটি নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক পরিবেশে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। গাজীপুরে একটি চমৎকার ও উৎসবমুখর পরিবেশ বজায় রয়েছে।

বিএনপির গণসংযোগ : বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার গতকাল দিনব্যাপী মহানগরের বাসন অঞ্চলে গণসংযোগ ও পথসভা করেন। তিনি সকাল ৯টার দিকে বাসন ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের মোগরখালে পথসভার মাধ্যমে তার নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। মাঝে জুমার বিরতি নিয়ে তিনি টিএন্ডটি কলোনি জামে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন এবং মুসল্লিদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। তিনি মুসল্লিদের কাছে দোয়া চেয়ে বক্তৃতাও করেন। তিনি পর্যায়ক্রমে বাসন অঞ্চলের ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের যোগীতলা নতুন বাজার, চান্দনা মোশারফের স্কুল (দক্ষিণপাড়া), ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ীয়ালী নগপাড়া মণ্ডলবাড়ী মসজিদ সংলগ্ন, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাজীম উদ্দিন মার্কেট, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের ইটাহাটা রাস্তার মাথা, হক মার্কেট ও কাউন্সিলর ফয়সাল সরকারের অফিস প্রাঙ্গণে পথসভা করেন।

১১৪ প্রার্থী নজরদারিতে : গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১১৪ জন প্রার্থী কোনো না কোনো মামলার আসামি হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে মেয়র ও মহিলা কাউন্সিলর প্রার্থীদের নামে নেই কোনো মামলা। এসব প্রার্থী যাতে নির্বাচনে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারেন সেজন্য তাদের নজরদারিতে রেখেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পাশাপাশি বিভিন্ন দাগি আসামিকেও নজরদারিতে রেখেছে তারা।

তবে গাজীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু করতে যত ধরনের প্রস্তুতি তার পুরোটাই নিয়েছি। প্রার্থীদের মধ্যে যারা মামলার আসামি, তারা যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলায় জড়িয়ে না পড়েন সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।’ এদিকে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বী ২৫৬ জনের মধ্যে ১১৪ জনই দাগি আসামি হওয়ায় ৫৭ ওয়ার্ডের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এক ধরনের আলোচনা-সমালোচনা দেখা দিয়েছে। আর এ কারণে কোন প্রার্থীকে ভোট দেবেন এমন শঙ্কায় রয়েছেন ভোটাররা। হলফনামা থেকে দেখা গেছে, ২৫৬ প্রার্থীর মধ্যে ১১৪ জনই কোনো না কোনো মামলার আসামি। তবে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্বরত রিটার্নিং কর্মকর্তা রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, মামলায় সাজা না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে কোনো আইনগত সমস্যা নেই।

হলফনামাসূত্রে জানা গেছে, ৫৭ ওয়ার্ডের ৫টির ২০ প্রার্থীর নামে কোনো মামলা নেই। ৩টি ওয়ার্ডের প্রত্যেক প্রার্থীর নামেই মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৮ প্রার্থীর মধ্যে ৫, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৭ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ২, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ৪, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ১, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ১, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ১, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২ প্রার্থীর মধ্যে ১, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ২, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ৮ প্রার্থীর মধ্যে ৬, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৭ প্রার্থীর মধ্যে ২, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১২ প্রার্থীর মধ্যে ৫, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ২, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৮ প্রার্থীর মধ্যে ৪, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ১, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে ৭ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ৪, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৭ প্রার্থীর মধ্যে ৪, ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৪৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডে ১১ প্রার্থীর মধ্যে ৪, ৫০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ প্রার্থীর মধ্যে ১, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৫২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৮ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ৩, ৫৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ২, ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৫ প্রার্থীর মধ্যে ২ এবং ৫৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৬ প্রার্থীর মধ্যে ১ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। হলফনামায় দেখা গেছে, ২১, ৩৮, ৩৯, ৪১ ও ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। তবে ২০, ২৮ ও ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের সব প্রার্থীর নামে মামলা রয়েছে।

গাজীপুর জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর নজরদারি করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আমি মনে করি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গাজীপুর সিটি নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে কোনো বিশৃঙ্খলা হলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে।’

 

সর্বশেষ খবর