শুক্রবার, ১০ আগস্ট, ২০১৮ ০০:০০ টা

স্বাস্থ্য প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ

শহিদুলের মুক্তি চেয়ে ৬৯ নাগরিকের বিবৃতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় রিমান্ডে থাকা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে কিনা তা জানতে চেয়েছে হাই কোর্ট। ২০১৩ সালের নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের ২(৬) ধারা অনুসারে তা পরীক্ষা করে প্রতিবেদন আকারে আদালতে দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি রিটের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে গতকাল বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন এবং বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। স্বরাষ্ট্র সচিবকে ১৩ আগস্টের মধ্যে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে ওই প্রতিবেদন দাখিল করতে হবে।

আদালতে শহিদুল আলমের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার সারা হোসেন, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক, রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।

এর আগে শহিদুল আলমকে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাত দিনের রিমান্ড আদেশ চ্যালেঞ্জ করে ও তার সুচিকিৎসার নির্দেশনা চেয়ে হাই কোর্টে রিট করেন তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ। সেই রিটের শুনানি নিয়ে ৭ আগস্ট আদালত আদেশ দেয়। আদেশে শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে রমনা থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে করা মামলায় তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসার নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। একইসঙ্গে একটি বোর্ড গঠন করে ৯ আগস্ট সকাল ১০টার মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাসপাতালে শহিদুল আলমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। পরে সেই প্রতিবেদনের ওপর শুনানি হয়। শুনানিতে ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, শহিদুল আলমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তাতে চারজন চিকিৎসকের নাম আছে। তবে তাদের মধ্যে কোনো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। অথচ হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের ২(৬) ধারায় ‘নির্যাতন’ বলতে কষ্ট হয় এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু শহিদুল আলমের মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে এই প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। আমরা জামিন চাইতে আসিনি, আমরা চাই মেডিকেল প্রতিবেদন সঠিকভাবে আসুক। পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম শুনানিতে বলেন, এই রিট চলতে পারে না। তাকে সঠিকভাবেই গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে রিমান্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জামিনের আবেদন করেছেন, তা নাকচ হয়েছে। তাকে নির্যাতন করা হয়নি। পরে সারা হোসেন আদালতে বলেন, শহিদুল আলমের মুখে ঘুষি মারা হয়েছে। তার নাকের চারপাশে কী অবস্থা তা পরীক্ষা করে শারীরিক অবস্থা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া মানসিক পরীক্ষা করাও জরুরি। এরপর আদালত রিট নিষ্পত্তি করে আদেশ দেয়। উল্লেখ্য, নিরাপদ সড়কের দাবিতে থাকা শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম  সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন। ওই ঘটনায় রমনা থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার দেখায়।

ভারতীয় আলোকচিত্রী রঘু রাইয়ের চিঠি : আলোকচিত্রী ড. শহিদুল আলমের গ্রেফতার ও তার ওপর হামলার নিন্দা জানালেন ভারতের বিশিষ্ট ফটো সাংবাদিক রঘু রাই। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের পাশাপাশি তাঁর দ্রুত মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠিও লিখেছেন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর তোলা একাধিক ছবির জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে রঘু রাই লেখেন, ‘আমি বিনীতভাবে অনুরোধ ও মিনতি করছি যেন যুবসমাজের সৎ ও সত্যবাদী প্রতিনিধিদের শাস্তি দেওয়া না হয়। গণতন্ত্রের উদ্দীপনা হিসেবে সত্যকে অবশ্যই তার নিজের জন্য বেঁচে থাকতে হবে, যা আপনার দেশের লাখ লাখ মানুষ ও আমাদের অনেকের হৃদয়কেও উদ্দীপ্ত করবে।’

শহিদুল আলমের পক্ষে ৬৯ নাগরিকের বিবৃতি নির্যাতনের তীব্র নিন্দা : তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় রিমান্ডে থাকা আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ৬৯ নাগরিক। বিবৃতিদাতারা শহিদুল আলমকে রিমান্ডে নেওয়া ও তার ওপর সরকারের নিপীড়নের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন মানবাধিকারকর্মী ড. হামিদা হোসেন, স্থপতি বশিরুল হক, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, শাহনি আনাম, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ প্রমুখ। ৮ আগস্ট এক বিবৃতিতে তারা বলেন, সম্প্রতি স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করেছে। বলা হয়েছে পুলিশের উপস্থিতিতে সরকারি দলের অঙ্গ-সংগঠন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং কর্তব্যরত সাংবাদিক ও চিত্রসাংবাদিকদের ওপর হামলা করেছে। এ ছাড়া কয়েক শ শিক্ষার্থীকে বেআইনি আটক ও রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে গর্ভবতী নারীও রয়েছেন। ৫ আগস্ট খ্যাতিমান আলোকচিত্রী, মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলম বাসা থেকে বেআইনি অপহরণের শিকার হন। অভিযোগ ওঠে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তাকে তুলে নিয়ে গেছে। এরপর তাকে আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেওয়া হয়।

আমরা আইসিটি আইনে শহিদুল আলমকে রিমান্ডে নেওয়া এবং তার ওপর সরকারের নিপীড়নের তীব্র নিন্দা জানাই। বেআইনিভাবে শহিদুল আলমের গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিষয়টির তদন্ত এবং তার শিগগিরই মুক্তি দাবি করছি। একই সঙ্গে তার অপহরণ ও নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শাস্তি দাবি করছি। তিনি বেআইনি কিছু করে থাকলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু বেআইনি অপহরণ ও অযৌক্তিক রিমান্ডে নেওয়া, বিশেষ করে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন গ্রহণযোগ্য নয়।

আমরা আরও দাবি করছি যে, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর সরকারের দমন ও নির্যাতন অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে আন্দোলনরতদের মধ্যে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের মুক্তি দিতে হবে। এ ছাড়া নিরাপদ সড়ক, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চলাফেরার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার ব্যবস্থা নেবে।

সর্বশেষ খবর