শুক্রবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা

শামসুর রাহমানের রসগোল্লা খাওয়া

ইমদাদুল হক মিলন

শামসুর রাহমানের রসগোল্লা খাওয়া

লায়ন সিনেমা হলের পশ্চিমপাশের গলিটা চলে গেছে নয়াবাজারের দিকে। এই গলি দিয়ে উত্তর দিকে এগোতে থাকলে বাঁদিকের ঠিক মোড়ে বাংলাভাষার মহান কবি শামসুর রাহমানের পুরনো দোতলা বাড়ি। সম্ভবত এই জায়গাটির নামই মাহুতটুলি। বাড়ির নিচতলায় প্রেস, ওপরতলায় শামসুর রাহমান থাকতেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়কার কথা। এই বাড়িতেই ঘটেছিল রসগোল্লার ঘটনা।

শামসুর রাহমানকে নিয়ে পাঁচজনের একটা দল ছিল আমাদের। দৈনিক বাংলার সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর আমি। দৈনিক বাংলায় শামসুর রাহমানের রুমে, ইউনিভার্সিটি ক্লাবে আবার কখনো কখনো ধানমন্ডির এক ফ্ল্যাটে আড্ডা দিতাম আমরা। ধানমন্ডির ফ্ল্যাটটি ছিল ইন্ডিয়ান হাইকমিশনের এক কর্মকর্তার ফ্ল্যাট। তিনি শামসুর রাহমানের মহাভক্ত। কোনো কোনো সন্ধ্যায় সেই ফ্ল্যাটে আমরা পাঁচজন হাজির হতাম। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা আর খাওয়া-দাওয়া চলত।

ইউনিভার্সিটি ক্লাবের আড্ডায় শামসুর রাহমান বেশি যেতেন না। বাকি চারজন আমরা প্রায় নিয়মিত। হুমায়ূন আহমেদ আর আমি কথা কম বলি। বেশি বলেন সালেহ ভাই। তাঁর সিলেটি উচ্চারণে একেকটা গল্প শুরু করতেন, সহজে আর থামতেনই না। হুমায়ুন আজাদ গল্পের মাঝখানে দুয়েকটা মন্তব্য করতেন। হুমায়ূন আহমেদ আর আমি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতাম আর সিগ্রেট টানতাম। একগল্প শেষ করে অন্যগল্প শুরু করতে গেলেই হুমায়ুন আজাদ বলতেন, গল্প কি খুব লম্বা? তাহলে বলবার দরকার নেই।

ওসব শ্লেষ সালেহ ভাই গায়েই মাখতেন না। তাঁর গল্প চলতই। হুমায়ুন আজাদ দুনিয়ার যাবতীয় বিরক্তি মুখে নিয়ে বসে থাকতেন। হুমায়ূন ভাই আর আমি, দুটি নিরীহ লেখক কী আর করি, সালেহ ভাইর ওই গল্প হাসি-হাসিমুখে শুনে যেতাম।

এক বিকালে শামসুর রাহমান তাঁর মাহুতটুলির বাড়িতে আড্ডা দিতে ডেকেছেন। সেই আড্ডায় হঠাৎ তিনি জানতে চাইলেন, আমি কোথায় থাকি। বললাম, গেন্ডারিয়া। গেন্ডারিয়া শুনেই বললেন, গেন্ডারিয়ার সোনামিয়ার মিষ্টির দোকানের রসগোল্লাটা অসাধারণ।

শুধু এটুকুই। বাকিটা বলে দিলেন সালেহ চৌধুরী। কবির জইন্য একদিন নিয়া আইসো মিলন। কবির ডায়াবেটিস আছে। তাও আইনো।

ওই বাড়িতে আমরা আড্ডা দিতাম প্রেসের অফিসরুমে। রুমে একজন ম্যানেজার বসতেন। আমরা গেলে রুমটা তিনি খালি করে দিতেন।

যা হোক পরের আড্ডায় আমি দুই প্যাকেট বড় সাইজের রসগোল্লা নিয়ে গেছি। অফিস রুমে বসে আছি। খানিকপর শামসুর রাহমান নেমে এলেন। প্যাকেটের গায়ে ‘সোনামিয়া মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’ নাম দেখে চোখ দুটো চকচক করে উঠল কবির। শিশুর মতো আনন্দে ফেটে পড়ল মুখ। সালেহ ভাই বললেন, প্যাকেট দুইটা ওপরতলায় পাঠাতে হয় যে কবি।

শামসুর রাহমান বললেন, দাঁড়ান দাঁড়ান। তারপর নিজহাতে প্যাকেট খুলে টপাটপ চারটা রসগোল্লা খেয়ে ফেললেন। আমরা হতবাক। কবির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওই সাইজের চারখানা রসগোল্লা খাওয়ার পর তাঁর রাজপুুরুষের মতো মুখখানিতে যেন শেষ বিকালের সবটুকু আলো এসে পড়েছে, এমন আলোকিত হয়েছে মুখ। লাজুক কণ্ঠে বললেন, এই রসগোল্লা ওপরে গেলে একটাও খেতে দেবে না আমাকে। এ জন্য আগেই...

আবার তাঁর সেই ভুবনভুলানো হাসি।

আমাদের সেই পাঁচজনের দল ধীরে ধীরে ভেঙে গেল। প্রথমে গেলেন কবি, তারপর হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, চলে গেলেন সালেহ চৌধুরী। হারাধনের শেষ সন্তানটার মতো আমি কায়ক্লেশে টিকে আছি।

শামসুর রাহমানের কথা আর আমাদের ওই দলটির কথা প্রায়ই মনে পড়ে। কতদিনের কত স্মৃতি। শামসুর রাহমান সবাইকে ‘আপনি’ করে বলতেন। আমাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আমাকে বলতেন ‘তুমি’ করে। তাঁর বাড়িতে গেলে পুত্রবধূ টিয়া অতিযত্নে এককাপ চা দিত। টিয়া এখনো মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজখবর নেয়। কবি লেখক কেউ চলে গেলেই মন খারাপ করা গলায় ফোন করে টিয়া। পুত্রবধূটিকে কী যে ভালোবাসতেন কবি! টিয়াও যে কী যত্ন নিত কবির, বলে বোঝানো যাবে না। শামসুর রাহমান শারীরিকভাবে নেই, রয়ে গেছে তাঁর অমর কবিতাগুলো। এই মুহূর্তে একটি কবিতার লাইন মনে পড়ছে...

ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা

এবার আমি গোলাপ নেবো।

সর্বশেষ খবর