শুক্রবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮ ০০:০০ টা
পিছনে ফেলে আসি

শওকত ওসমানের মায়াবী হাত

ইমদাদুল হক মিলন

শওকত ওসমানের মায়াবী হাত

শওকত ওসমান বসে আছেন নওরোজ কিতাবস্থানে। বাংলাবাজারে নওরোজ  কিতাবস্থানের বিশাল শোরুম। শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী সাহেবের বড় ছেলে ইফতেখার রসুল জর্জ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। তার সামনে বসে আছেন শওকত ওসমান। চা-শিঙাড়া খাচ্ছেন। তিরাশি-চুরাশি সালের কথা। আমি থাকি গেন্ডারিয়ায়। লেখালেখি ছাড়া আর কিছু করি না। ১১-১২টার দিকে প্রতিদিন যাই বাংলাবাজারে। জর্জ ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা দিই। চা-শিঙাড়া খাই। ফুক ফুক করে সিগারেট টানি। অনেক লেখক কবিই আসেন এই আড্ডায়। প্রচ্ছদ শিল্পীরা আসেন। সারাক্ষণ জমজমাট নওরোজ কিতাবস্থান। হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ আসতেন নিয়মিত। এক-দেড় বছর পর আসতে শুরু করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। শিল্পী মাসুক হেলাল আসতেন নিয়মিত। শওকত ওসমানকে চেহারায় চিনতাম। এত বড় লেখক এত শ্রদ্ধেয়জন তাঁকে না চিনবার কারণ নেই। পত্রপত্রিকায় কত ছবি দেখেছি তাঁর, কত লেখা পড়েছি। ‘জননী’, ‘কৃতদাসের হাসি’। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন কলকাতায়। ‘আনন্দবাজার’ না ‘দেশ’ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় লিখলেন ‘জাহান্নম হইতে বিদায়’ নামে উপন্যাস। ‘জলসা’ না ‘উল্টোরথ’। পত্রিকায় যেন লিখলেন ‘জলাঙ্গী’ নামে উপন্যাস। পাঠ্যবইতে তাঁর গল্প পড়েছি। শিক্ষক এবং পণ্ডিত হিসেবে বিখ্যাত। কলকাতার বড় লেখকদের পাশাপাশি তাঁর নাম উচ্চারিত হয়। সেই মানুষ বসে আছেন জর্জ ভাইয়ের সামনে। জর্জ ভাই তাঁকে চাচা ডাকেন। কারণ তিনি মোহাম্মদ নাসির আলী সাহেবের বন্ধু। জর্জ ভাই তাঁর প্রকাশকও। তিনি চারটা বই ছেপেছেন। ‘চৌরসন্ধী’ ‘পিতৃপুরুষের পাপ’ ‘শংকর, সংকীর্তন’, মির্জা সাহেবের গল্প’। ‘জলাঙ্গী’ বইটাও জর্জ ভাই ছেপেছিলেন। পরে দেখেছি নওরোজ কিতাবস্থানে ঢুকেই শওকত ভাই বলছেন, বাবা, আমাকে একটা কোক খাওয়াও। আমি কিন্তু সেভেন্টি টু নট আউট। অর্থাৎ শওকত ভাইয়ের বয়স তখন ৭২ বছর। জর্জ ভাইকে ডাকতেন বাবা। জর্জ ভাই সঙ্গে সঙ্গে কোকের অর্ডার দিতেন। শওকত ওসমানের সঙ্গে জর্জ ভাই পরিচয় করিয়ে দিলেন। শওকত ভাই গভীর আন্তরিকতা নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন। আমার দুয়েকটা লেখা তিনি পড়েছেন। সেই সব লেখার কথা বললেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত প্রখর। পড়াশোনা এবং ভাবনার জগিট বিশাল আর মানুষটি শিশুর মতো সরল। সেই যে পরিচয় হলো তারপর বিভিন্ন জায়গায় শওকত ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়। দেখা হলেই নিবিড় স্নেহের গলায় কথা বলেন। লেখালেখির খোঁজখবর নেন। ‘রোববার’ পত্রিকায় আমার একটি উপন্যাস ছাপা হলো। উপন্যাসের নাম ‘বনমানুষ’। শওকত ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ের বছর দু-তিনেক কেটে গেছে। ‘বনমানুষ’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল নতুন আঙ্গিকে। পুরো উপন্যাসটিই শুধু সংলাপে লেখা। ভাষা ব্যবহারেও নতুনত্ব ছিল। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, মানুষ যখন তার ঘরে একেবারে নিজস্ব আবহে কথা বলে তখন তার ভাষা থাকে একরকম, যখন সে ঘরের বাইরে বড় পরিবেশে যায় তখন তার ভাষা হয় অন্যরকম, আর যখন সে তার স্ত্রী কিংবা প্রেমিকার সঙ্গে গভীর কোনো বনে একা হয়ে যায়, শরীরী প্রেমে মগ্ন হয় তখন এই পরিচিতি প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা স্বামী-স্ত্রীটির ভাষা হয়ে ওঠে ক্লাসিকস। এই উপন্যাস পড়ে শওকত ভাই আমাকে তিন পৃষ্ঠার একটি চিঠি লিখলেন। নওরোজ কিতাবস্থানের ঠিকানায়। ডাকে। সেই চিঠি আমার সাহিত্যিক জীবনের এক বিশাল প্রাপ্তি। আরেকজন বিশাল মাপের কবি ঔপন্যাসিক প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষক পণ্ডিত হুমায়ুন আজাদও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন এই উপন্যাসের। উপন্যাসটি হুমায়ুন আজাদকে উৎসর্গ করা। পরে এই উপন্যাস নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন। সেও আমার জীবনের এক বড় প্রাপ্তি। কত বড় বড় সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী ছিলেন আমাদের। মৃত্যু তাঁদের বহুদূর সরিয়ে নিয়েছে। ‘পিছনে ফেলে আসি’ কলামটি আমি লিখি আসলে সেইসব মহান লেখক শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য।

দিন চলে যায়। শওকত ভাইকে দেখি প্রায় প্রতিদিনই বেইলি রোডের সাগর পাবলিশার্সে বসে আড্ডা দেন। প্রতিষ্ঠানটির মালিক আমাদের সবার প্রিয় এম আর আকতার মুকুল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বিখ্যাত শব্দ সৈনিক। একাত্তর সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রতি রাতে ‘চরমপত্র’ নামে তিনি তাঁর লেখা পাঠ করতেন। সেই লেখা মানে কোথায় কোথায় পাকিস্তানিরা বেধড়ক মার খাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে, অত্যন্ত রসালো ভাষায় এবং ভঙ্গিতে তিনি তা পরিবেশন করতেন। মুকুল ভাইয়ের ‘চরমপত্র’ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সবচাইতে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। বাঙালি জাতি উন্মুখ হয়ে থাকত এই অনুষ্ঠান শোনার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেকগুলো বই লিখেছেন মুকুল ভাই। তাঁর সবচাইতে জনপ্রিয় বই ‘আমি বিজয় দেখেছি’ লাখ লাখ কপি বিক্রি হয়েছে। ‘চরমপত্র’ নামেও তাঁর একটি বই আছে। সাগর পাবলিশার্সের স্লোগান ছিল ‘তবুও বই পড়ুন’। এখনো সেই স্লোগান ধারণ করে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। মালিকানা বদল হয়েছে মুকুল ভাই চলে যাওয়ার কয়েক বছর পর।

এক বিকালে সাগর পাবলিশার্সে গেছি। দেখি শওকত ভাই বসে মুকুল ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছেন। সৈয়দ শামসুল হক এলেন। অতি ভক্তিভরে শওকত ভাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলেন। আমি শিখলাম একজন বড় লেখক কীভাবে আরেকজন বড় লেখককে সম্মান করেন। তারপর থেকে দেখা হলে শওকত ওসমান এবং সৈয়দ শামসুল হক দুজনকেই আমি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতাম। এবার একটি বিস্ময়কর ঘটনার কথা বলি। আমার ছোট মেয়েটির তখন আড়াই বছর বয়স। এমন জ্বর হয়েছে, আমরা দিশাহারা। শান্তিনগরের একটা ক্লিনিকে ভর্তি করিয়েছি। আমার স্ত্রী বসে আছেন মেয়ের শিয়রে। ডাক্তাররা চিন্তিত। আমার মন খুবই খারাপ। হাঁটতে হাঁটতে গেছি সাগর পাবলিশার্সে। গিয়ে দেখি শওকত ভাই বসে আছেন। চশমার ভিতর থেকে তীক্ষ চোখে তাকালেন আমার দিকে। মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন, মিলন? কী হয়েছে? মেয়ের কথা বললাম। তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন, আশ্বস্ত করা গলায় বললেন, চিন্তা কর না। ঠিক হয়ে যাবে।

রাত ৯টার দিকে গেছি ক্লিনিকে। স্ত্রী বললেন, বয়স্ক এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। নাম বলেননি। মেয়ের কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছেন। মেয়ের মাথায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে বলেছেন, বউমা, তোমরা চিন্তা কর না। মেয়ে সুস্থ হয়ে যাবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, আরে, এ তো শওকত ভাই! আমার মুখে মেয়ের জ্বরের কথা শুনে তাকে দেখতে এসেছিলেন। আমার স্ত্রী তাঁকে চিনতে পারেননি। আমার মুখে শওকত ভাইয়ের কথা শুনে খুবই লজ্জা পেলেন ভদ্র মহিলা। পরে শওকত ভাইয়ের সঙ্গে তাকে আমি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। শওকত ভাইকে আমার গেন্ডারিয়ার বাসায় নিয়েও গিয়েছিলাম। আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই যে ক্লিনিকে গিয়ে শওকত ভাই আমার মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মুহূর্ত থেকে মেয়ের জ্বর কমতে লাগল। সেই রাতে জ্বর আর এলোই না। পরদিন সকালে সে অনেকখানি সুস্থ। একদিন পর তাকে আমরা বাসায় নিয়ে এলাম। এই ঘটনা কি কোনো মানুষের পক্ষে ভোলা সম্ভব? শওকত ভাইয়ের কথা মনে হলেই ঘটনাটি আমার মনে পড়ে। কত বড় মানুষ হলে আমার মতো তুচ্ছ এক লেখকের মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে তাকে দেখতে ক্লিনিকে ছুটে যান! নিজের পরিচয়ও দেন না! শওকত ভাইয়ের মতো মানুষরাই তো চিরস্মরণীয়। সাহিত্যিক হিসেবে, মানুষ হিসেবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর