শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

নিমতলী থেকে চকবাজার ট্র্যাজেডি

কেমিক্যাল গুদামেই সর্বনাশা মৃত্যুকূপ

সাঈদুর রহমান রিমন

নিমতলী থেকে চকবাজার ট্র্যাজেডি

নিমতলী ঘটনারই প্রায় হুবহু পুনরাবৃত্তি ঘটেছে গতকাল রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার চুড়িহাট্টির অগ্নিকাে । দায়িত্বহীনতায় ফেলে রাখা বিপজ্জনক সব কেমিক্যাল নিমতলী স্টাইলে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে চকবাজারের চুড়িহাট্টি মহল্লার পাঁচটি বিশাল অট্টালিকা। কেড়ে নিয়েছে ৭০ জনেরও বেশি মানুষের প্রাণ। রাজধানীর চানখারপুল-সংলগ্ন নিমতলীতে ২০১০ সালের ৩ জুন রাতে বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ থেকে ধরে যাওয়া আগুনে ১২৪ জন প্রাণ হারান। আহত হন অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান, কারখানা, প্রিয়জন আর মানুষের অজস্র স্বপ্ন। উভয় ঘটনাস্থলের পাশে ছিল বিপদজ্জনক কেমিক্যালের গুদাম। দাহ্য পদার্থ ছিল চারপাশজুড়েই।  নিমতলীর ঘটনার পর ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ সব এলাকা থেকে কেমিক্যালের বাণিজ্য সরিয়ে তা জনবসতিহীন ফাঁকা এলাকায়  নেওয়া হবে। গড়ে তোলা হবে আলাদা কেমিক্যাল পল্লী। এ উপাদান খোলামেলাভাবে বাজারজাত করার সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। বলা হয়েছিল, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সকে অত্যন্ত শক্তিশালী সংস্থায় পরিণত করা হবে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সরকারি প্রতিশ্রুতি, উদ্যোগ আয়োজন সব কিছুতে ভাটা পড়েছে। ছাই চাপা দেওয়া হয়েছে সব। প্রায় ১০ বছরেই দায়িত্বশীলরা ভুলেই যেতে বসেছিল নিমতলীর ট্র্যাজেডির-সেই সব বীভৎসতা। তাই আবারও এ ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কেমিক্যাল বাণিজ্যের সামনে মাথানত করে গোটা দেশ, প্রশাসন। অঘোষিতভাবে আত্মসমর্পণ করতে কারও লজ্জা হয়নি। নিমতলী ঘটনার প্রায় ১০ বছরের কাছাকাছি এসে আজও অভিন্ন স্টাইলেই চলছে অবৈধ কেমিক্যাল বাণিজ্য। আজও চারপাশে খোলামেলাভাবেই পড়ে থাকছে ভয়ঙ্কর সব দাহ্য পদার্থ। যেসব দ্রব্যাদি সামান্য আগুনের স্ফুলিঙ্গের ছোঁয়া পেলেই চোখের নিমিষে একর পর এক অট্টালিকা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে পারে, মানুষজনকে মুহূর্তেই কয়লা কিংবা ছাইয়ে পরিণত করতে পারে, সেই কেমিক্যালের অবৈধ বাণিজ্য আরও ফুলেফেপে চাঙ্গা হয়েছে। মহল্লায় মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে কেমিক্যালের সা¤্রাজ্য। সে বাণিজ্যের দাপুটে দৌরাত্ম্য এখন ঢুকে পড়েছে পুরান ঢাকাবাসীর বেডরুমেও। নিমতলী ট্র্যাজেডির প্রত্যক্ষদর্শীদের কণ্ঠে এখন হতাশার সুর বাজে। তাদের চকবাজারের ট্র্যাজেডির খবরেও শোকসন্তপ্ত মানুষজনের পাশে সান্ত্বনার সমবেদনা নিয়ে হাজির হতে দেখা গেছে। ক্ষোভ আর বেদনাজড়িত কণ্ঠেই বলে উঠেছেন তারা- নিমতলী ট্র্যাজেডি থেকে আমরা কোনো শিক্ষাই নেইনি। এমন সর্বনাশা ঘটনাও আমাদের পথ দেখাতে পারেনি। পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় বিপজ্জনক কেমিক্যালের শত শত কারখানা ও গুদাম রয়েছে। প্রায়ই কেমিক্যাল কারখানায় আগুন লেগে নানা দুর্ঘটনা ঘটে। দাবি ওঠে সেসব কারখানা ও গুদাম ওই এলাকা থেকে অবিলম্বে সরিয়ে নেওয়ার। এ ব্যাপারে সরকারও কেমিক্যালের গুদাম এবং কারখানা সরাতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই কারখানা ও গুদাম এখনো সরানো হয়নি, যা ঝুঁকিপূর্ণ বলেছে ফায়ার সার্ভিস। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বার বার কেমিক্যালের গুদাম ও কারখানা সরানোর উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাস দিলেও সেটি তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি।

নিমতলী ট্র্যাজেডির রেশ কাটতে না কাটতে একই বছর ১০ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর টাম্পাকো অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণজনিত অগ্নিকাে ন অর্ধশতাধিক ব্যক্তি দগ্ধ হন। প্রাণী ও উদ্ভিদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। ৬ অক্টোবর যাত্রাবাড়ী দোলাইপাড়ের সম্রাট কমিউনিটি সেন্টার-সংলগ্ন লিলি কেমিক্যালের জুতার সোল তৈরির কারখানায় আগুন লেগে সাতজন মারা যান। সম্প্রতি পুরান ঢাকার ইসলামবাগ এলাকায় এক কেমিক্যাল কারখানা থেকে সূত্রপাত হওয়া আগুনে অন্তত ৪০টি কারখানা-গুদাম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সর্বস্বান্ত হয়েছে সেসব কারখানা-গুদামের মালিকরা। ফায়ার সার্ভিসের একজন অগ্নিনির্বাপক গাড়ির চালক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, রাজধানীর লালবাগ, চকবাজার, ইসলামবাগ, কামরাঙ্গীরচর, যাত্রাবাড়ী, বংশাল, জিন্দাবাহার, গে ারিয়ার কেমিক্যাল কারখানা ও গুদাম কেন্দ্রিক প্রতি বছর কয়েকদফা অগ্নিকা  এবং মূল্যবান জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যেন রুটিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সর্বশেষ গত বুধবার রাতে চকবাজার চুড়িহাট্টির ওয়াহিদ ভবনসহ যে পাঁচটি বড় ভবনজুড়ে ভয়াবহ অগ্নিকাে  জানমালের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে এর পেছনেও কেমিক্যাল কারখানা, গুদাম আর দোকানপাটকেই দায়ী করেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা। সেখানকার বেশিরভাগ আবাসিক ভবনের ছাদেও টিনশেড ঘর বানিয়ে সব ধরনের নকল প্রসাধনী প্রস্তুতের অবৈধ কারখানা স্থাপিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর