রবিবার, ৭ এপ্রিল, ২০১৯ ০০:০০ টা

নগরকান্দায় জামাল কামাল বাহিনীর তাণ্ডব

হাতুড়িপেটায় ১২ দিন পর মারা গেলেন বৃদ্ধ সোবহান

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগরকান্দায় জামাল কামাল বাহিনীর তাণ্ডব

অভিযুক্ত জামাল

ফরিদপুরের নগরকান্দা-সালথা নির্বাচনী এলাকায় ভয়ঙ্কর হিসেবে পরিচিত জামাল-কামাল বাহিনীর হাতুড়িপেটায় এবার মারা গেছেন সোবহান মাতুব্বর (৫০) নামের এক ব্যক্তি। নিহত সোবহান নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের কোনাগ্রামের বাসিন্দা। জামাল-কামাল বাহিনীর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা মধ্যযুগীয় কায়দায় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে নিরীহ সোবহানকে। ১২ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মানতে হয় তার। সোবহান মাতুব্বর নিহতের ঘটনায় এলাকাজুড়ে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। সোবহান মাতুব্বর হত্যায় জড়িত জামাল-কামালের ফাঁসি চেয়ে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এদিকে সোবহান মাতুব্বরের মৃত্যুর পর এলাকায় উত্তেজনা  বিরাজ করছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কোনাগ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের কোনাগ্রামে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুটি গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল চলে আসছিল। স্থানীয় সাহাবুদ্দিন মেম্বার গ্রুপ ও বাবুল মোল্লার গ্রুপের মধ্যকার দ্বন্দ্বে এলাকায় বেশ কয়েক দফা হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সাহাবুদ্দিন মেম্বার সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সমর্থক। অন্যদিকে বাবুল মোল্লা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জামাল হোসেন মিয়া ও জেলা পরিষদের সদস্য কামাল হোসেন মিয়ার সমর্থক। জামাল-কামাল বাহিনী এলাকায় শক্তিশালী হওয়ায় তারা সাহাবুদ্দিন মেম্বারের সমর্থকদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালায়। গত তিন মাসে কয়েক দফা হামলা চালিয়ে জামাল-কামাল বাহিনীর সদস্যরা অর্ধশতাধিক বাড়ি ভাঙচুর ও লুটপাট করেছে। পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছে কয়েকজনকে। স্থানীয় অধিবাসীরা অভিযোগ করে বলেন, নগরকান্দা ও সালথায় জামাল-কামাল বাহিনীর সন্ত্রাসীরা এতটাই বেপরোয়া যে, তাদের ভয়ে এলাকায় কেউ টুঁ শব্দটি করতে সাহস পায় না। এর আগে এই জামাল ঢাকার বাড্ডা থানায় অস্ত্রসহ আটক হয়েছিলেন। তখন প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে রেহাই করে নিলেও পুলিশের তালিকায় তার অবস্থান অস্ত্রধারী হিসেবে। জামাল-কামাল বাহিনীর অত্যাচারে নগরকান্দা-সালথার অনেকেই এখন এলাকা ছেড়ে ফরিদপুর ও ঢাকায় বসবাস করছেন। এ বাহিনীর সদস্যরা প্রতিপক্ষের লোকজনকে বাগে পেলেই হামলে পড়ে। ২৫ মার্চ কোনাগ্রামের বাসিন্দা সাহাবুদ্দিন মেম্বারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বয়োবৃদ্ধ সোবহান মাতুব্বর তালমা বাজারে তার নাতির জন্য রসগোল্লা কিনতে যান। তালমা বাজার থেকে ফেরার পথে জামাল-কামাল বাহিনীর সদস্যরা বাবুল মোল্লার বাড়ির সামনে সোবহানকে ঘিরে ধরে। এ সময় এ বাহিনীর ২৫-২৬ জন সদস্য হাতুড়ি, লোহার রড, কাঠের বাটাম দিয়ে নৃশংসভাবে পিটিয়ে সোবহান মাতুব্বরকে গুরুতর জখম করে। সেই দিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী দুজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৃদ্ধ সোবহানের ওপর সন্ত্রাসীরা অমানুষিক নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে সোবহান সন্ত্রাসীদের পা ধরে প্রাণভিক্ষা চাইলেও তারা সে অনুরোধ রাখেননি। উপর্যুপরি সন্ত্রাসীরা হাতুড়িপেটা করে সোবহান মাতুব্বরের হাত-পাসহ দেহের বিভিন্ন অঙ্গ থেঁতলে দেয়। স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা সোবহানকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে গেলে জামাল-কামাল বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র উঁচিয়ে তাদের ভয় দেখায়। এতে তারা সরে যেতে বাধ্য হন। হামলায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকলে মৃত ভেবে সোবহানকে ফেলে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। যাওয়ার সময় সেখানে উপস্থিত কয়েকজনকে হুমকি দিয়ে সন্ত্রাসীরা বলে, এ ঘটনা পুলিশ বা অন্য কাউকে কেউ জানালে তাদেরও পরিণতি হবে সোবহান মাতুব্বরের মতো। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সোবহান মাতুব্বরকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে পাঠানো হয় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সেখানে ১২ দিন চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শুক্রবার সোবহান মাতুব্বর মারা যান। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এলাকায় তীব্র উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। নিহত সোবহানের হত্যাকারীদের বিচার চেয়ে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন এলাকাবাসী। এ সময় তারা হত্যায় জড়িত জামাল-কামালের ফাঁসি চেয়ে স্লোগান দেন। সাহাবুদ্দিন মেম্বার অভিযোগ করে বলেন, জামাল-কামালের নির্দেশে এবং উপস্থিতিতে সোবহানের ওপর হামলা চালায় বাবুল মোল্লা, সাদি মোল্লা, লাবুন মোল্লা, জাফর, সুজাত, ইউনুস, হাকিম, মোসলেম, রেজওয়ান, আলী মোল্লা, আজিজুল মাতুব্বর, সিরাজ শেখ, শাহ আলম, শহিদুল ইসলাম, বেলায়েত, সৈয়দ আলী, সামাদ মাতুব্বর, শাহজাহান শেখ, আপান শেখসহ আরও কিছু ব্যক্তি। জামালের নির্দেশেই সোবহানকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এলাকাবাসী জানান, গোটা নগরকান্দা এলাকায় জামাল-কামাল বাহিনী সন্ত্রাসের রামরাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। এ বাহিনীর সদস্যরা এতটাই ভয়ঙ্কর যে, প্রকাশ্য দিবালোকে তারা মানুষ হত্যা করতে পিছপা হয় না। এর আগে এ বাহিনীর হাতে নৃশংসভাবে খুন হয় স্কুলছাত্র আলাউদ্দিন মাতুব্বর অন্তর। অন্তরকে তারা অপহরণ করে একটি বাগানে নিয়ে হত্যা করে লাশ মাটিতে পুঁতে রাখে। অন্তর হত্যা মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করলেও পুলিশ তাদের আটক করার সাহস পায় না। এ ছাড়া জামাল-কামাল বাহিনীর সদস্যরা এর আগে নৃশংসভাবে হত্যা করে রামনগর এলাকার মাইক্রোবাসচালক শাহজাহানকে। রামনগর ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় জামাল-কামাল বাহিনীর সদস্যরা রাতের বেলা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় শাহজাহানকে। পরে তারা শাহজাহানকে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ গমখেতে ফেলে রাখে। ওই ঘটনার পর এলাকার মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে জামাল-কামালসহ ইউপি চেয়ারম্যানের ফাঁসি চেয়ে মিছিল-সমাবেশ করেন। সেই সময় বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তিনি হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবি জানান। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জামাল-কামাল বাহিনী এলাকায় ক্রমেই ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। কয়েকটি হত্যাকান্ডে র পর মামলার বাদীসহ তাদের স্বজনদের বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছে তারা। বাড়িঘরে হামলা করে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। এ বাহিনীর কবল থেকে বাঁচতে নগরকান্দাবাসী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জোর দাবি জানান। সোবহান মাতুব্বর হত্যার ঘটনায় নগরকান্দা থানা পুলিশ বাবুল মোল্লা ও লাবিন মোল্লা নামের দুজনকে আটক করেছে। নগরকান্দা থানার ওসি (তদন্ত) মিরাজ হোসেন বলেন, এ ঘটনায় দুজনকে আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্তদের আটক এবং মামলার প্রস্তুতি চলছে।

সর্বশেষ খবর