বৃহস্পতিবার, ১৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জ ও স্বস্তি ফেরানোর বাজেট আজ

মানিক মুনতাসির

চ্যালেঞ্জ ও স্বস্তি ফেরানোর বাজেট আজ

আজ জাতীয় সংসদে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জন্য ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বাজেটকে তিনি খুব সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপনের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশাল এই বাজেটে থাকছে বিরাট অঙ্কের ঘাটতিও। আসন্ন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ ৫ দশমিক ৫ শতাংশে রাখার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

সীমিত সম্পদের সুষম ব্যবহারের মাধ্যমে সমগ্র দেশের উন্নয়ন করতে চায় সরকার। বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের মধ্যকার বৈষম্য নিরসনে গ্রামাঞ্চলে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ভ্যাট ও করের বোঝা কমিয়ে অর্থের সংস্থানে করজাল বিস্তৃত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের আগেই বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চূড়ান্ত প্রবেশ করানোর জন্য আগামী ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কেননা চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অধিকাংশ বৃহৎ প্রকল্পই দু-এক বছরের মধ্যে সমাপ্ত হবে। ফলে এসব প্রকল্পে যেন কোনোভাবেই অর্থায়ন সংক্রান্ত সমস্যার সৃষ্টি না হয় সেদিকে বিশেষ নজর থাকছে।

নতুন এই বাজেটে প্রথমবারের মতো বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়াচ্ছে। তেমনিভাবে বাজেটের মোট আকারও প্রথমবারের মতো ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে এবার। এ ছাড়া ক্ষয়িষ্ণু ব্যাংকিং খাত ও টালমাটাল আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক সংস্কারের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে নতুন এই বাজেটে সামগ্রিক উন্নয়ন কর্মকা- সচল রেখে করের বোঝা কমিয়ে জনগণকে এক ধরনের স্বস্তির বার্তা দিতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার।

‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’ শিরোনামের এই বাজেট হবে প্রচলিত ধারার বাইরে। এবারের বাজেট হবে ‘স্মার্ট বাজেট’। সেখানে অর্থমন্ত্রী দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণের অঙ্গীকার তুলে ধরবেন। তিনি সেখানে শুধু এক বছরের জন্য নয়, সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য নিয়ে বিশেষ করে ২০৪১ সালকে লক্ষ্য করে বাজেট তৈরি করেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রথম অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এবারের বাজেট বক্তৃতার কলেবর কমিয়ে আনা হয়েছে ১৩৫ পৃষ্ঠায়। এর মধ্যে ১০০ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতা, বাকি ৩৫ পৃষ্ঠা পরিশিষ্ট। চলতি বছরের বাজেট বক্তৃতার কলেবর ছিল ১৫৬ পৃষ্ঠাবিশিষ্ট। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে আগামী বাজেট ১২ দশমিক ৬১ ও সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৮ দশমিক ২২ শতাংশ বড়। এটি দেশের ৪৮তম, আওয়ামী লীগ সরকারের ২০তম ও অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রথম বাজেট। তবে ১৯৯৬-৯৭ সালে একটি অন্তর্বর্তী বাজেট দেওয়া হয়। সেটাকে ধরা হলে এটি হবে ৪৯তম বাজেট। ১৭২-৭৩ সালের প্রথম বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা।

এরই মধ্যে বাজেট উপস্থাপনের জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আজ বেলা সাড়ে ১২টায় মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর অর্থমন্ত্রী বিকাল ৩টায় জাতীয় সংসদে তা উপস্থাপন করবেন। সেখানে তিনি আয়-ব্যয়ের হিসাব তুলে ধরবেন। করের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে আয় করবেন। আবার মানুষের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় করবেন।

সরকারের গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে আজকের বাজেটে। উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি সমন্বিত রূপরেখা দাঁড় করতে চায় সরকার। এক ছাতার নিচে আসবে সব উন্নয়ন এজেন্ডা, দিকনির্দেশনা দেবেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সর্বশেষ বছর। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ২০৩০, অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর-২০৪১, দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রস্তুতিকে বিবেচনায় নিয়ে এবারের নীতি-কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে।

অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় একসঙ্গে সব উন্নয়ন এজেন্ডা এবং লক্ষ্য নির্দিষ্ট করার প্রয়াস থাকবে। সব উন্নয়ন লক্ষ্যের সঙ্গে সমন্বয় করে তুলে ধরা হবে বাজেট। অর্থাৎ কোন খাতে ব্যয় বরাদ্দ দেওয়া দরকার, কোথায় বরাদ্দ কমিয়ে আনতে হবে তাও খতিয়ে দেখা হবে। বিশেষ করে সরকারের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থায়ন এবং কাজের রোডম্যাপ স্পষ্ট করা হবে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যাতে লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়, থাকবে তারও প্রয়াস। এজন্য অর্থমন্ত্রীর নজর থাকবে সম্পদের পুনর্বণ্টন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং আয় বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধির। এই লক্ষ্য পূরণে আগামী অর্থবছরে বাজেটের আয়তনও বাড়ানো হয়েছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, আগামী অর্থবছরের বাজেটের সম্ভাব্য আকার থাকবে ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এই ব্যয়ের মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। আর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা হতে পারে ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) আদায় করতে হবে সোয়া ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। নন এনবিআর রাজস্ব ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। করবহির্ভূত রাজস্ব ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেট ছিল ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার।

নতুন বাজেটে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। বরাবরের মতো ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যেই থাকবে। তবে সমস্যা মূলত ঘাটতি অর্থায়নের উৎস নিয়ে। যেমন নতুন বাজেটে ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হচ্ছে ৩ লাখ ১০ হাজার ২৬২ কোটি টাকা। উন্নয়ন ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ লাখ ১১ হাজার ৬৮৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার ২ লাখ ২ হাজার ৭২১ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে অনুদান ছাড়া বাজেট ঘাটতি হতে পারে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। এ ঘাটতি চলতি অর্থবছরের বাজেটে ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে ৬৩ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেওয়া হবে ৭৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা এবং জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর